Monday, September 12, 2016

আমার গানের মালা আমি করব কারে দান।

আমার গানের মালা
আমি করব কারে দান।
মালার ফুলে জড়িয়ে আছে
করুণ অভিমান।
মালা করব কারে দান।।

চোখে মলিন কাজল রেখা
কন্ঠে কাঁদে কুহু কেকা।
কপোলে যার অশ্রু রেখা
একা যাহার প্রাণ।।

শাঁখায় ছিল কাঁটার বেদন
মালায় শুচির জ্বালা।
কন্ঠে দিতে সাহস না পাই
অভিশাপের মালা।।

বিরহে যার প্রেমারতি
আঁধার লোকের অরুণধুতি।।
নাম না জানা সেই তপোতী
তার তরে এই গান।।

দারিদ্র্য

কাজী নজরুল ইসলাম

হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান্‌।
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান
কন্টক-মুকুট শোভা।-দিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,
বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার!
দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস,
অম্লান স্বর্ণেরে মোর করিলে বিরস,
অকালে শুকালে মোর রূপ রস প্রাণ!
শীর্ণ করপুট ভরি’ সুন্দরের দান
যতবার নিতে যাই-হে বুভুক্ষু তুমি
অগ্রে আসি’ কর পান! শূন্য মরুভূমি
হেরি মম কল্পলোক। আমার নয়ন
আমারি সুন্দরে করে অগ্নি বরিষণ!
বেদনা-হলুদ-বৃন্ত কামনা আমার
শেফালির মত শুভ্র সুরভি-বিথার
বিকশি’ উঠিতে চাহে, তুমি হে নির্মম,
দলবৃন্ত ভাঙ শাখা কাঠুরিয়া সম!
আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল
ক’রে ওঠে সারা হিয়া, শিশির সজল
টলটল ধরণীর মত করুণায়!
তুমি রবি, তব তাপে শুকাইয়া যায়
করুণা-নীহার-বিন্দু! ম্লান হ’য়ে উঠি
ধরণীর ছায়াঞ্চলে! স্বপ্ন যায় টুটি’
সুন্দরের, কল্যাণের। তরল গরল
কন্ঠে ঢালি’ তুমি বল, ‘অমৃতে কি ফল?
জ্বালা নাই, নেশা নাই. নাই উন্মাদনা,-
রে দুর্বল, অমরার অমৃত-সাধনা
এ দুঃখের পৃথিবীতে তোর ব্রত নহে,
তুই নাগ, জন্ম তোর বেদনার দহে।
কাঁটা-কুঞ্জে বসি’ তুই গাঁথিবি মালিকা,
দিয়া গেনু ভালে তোর বেদনার টিকা!….
গাহি গান, গাঁথি মালা, কন্ঠ করে জ্বালা,
দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ-নাগবালা!….
ভিক্ষা-ঝুলি নিয়া ফের’ দ্বারে দ্বারে ঋষি
ক্ষমাহীন হে দুর্বাসা! যাপিতেছে নিশি
সুখে রব-বধূ যথা-সেখানে কখন,
হে কঠোর-কন্ঠ, গিয়া ডাক-‘মূঢ়, শোন্‌,
ধরণী বিলাস-কুঞ্জ নহে নহে কারো,
অভাব বিরহ আছে, আছে দুঃখ আরো,
আছে কাঁটা শয্যাতলে বাহুতে প্রিয়ার,
তাই এবে কর্‌ ভোগ!-পড়ে হাহাকার
নিমেষে সে সুখ-স্বর্গে, নিবে যায় বাতি,
কাটিতে চাহে না যেন আর কাল-রাতি!
চল-পথে অনশন-ক্লিষ্ট ক্ষীণ তনু,
কী দেখি’ বাঁকিয়া ওঠে সহসা ভ্রূ-ধনু,
দু’নয়ন ভরি’ রুদ্র হানো অগ্নি-বাণ,
আসে রাজ্যে মহামারী দুর্ভিক্ষ তুফান,
প্রমোদ-কানন পুড়ে, উড়ে অট্টালিকা,-
তোমার আইনে শুধু মৃত্যু-দন্ড লিখা!
বিনয়ের ব্যভিচার নাহি তব পাশ,
তুমি চান নগ্নতার উলঙ্গ প্রকাশ।
সঙ্কোচ শরম বলি’ জান না ক’ কিছু,
উন্নত করিছ শির যার মাথা নীচু।
মৃত্যু-পথ-যাত্রীদল তোমার ইঙ্গিতে
গলায় পরিছে ফাঁসি হাসিতে হাসিতে!
নিত্য অভাবের কুন্ড জ্বালাইয়া বুকে
সাধিতেছ মৃত্যু-যজ্ঞ পৈশাচিক সুখে!
লক্ষ্মীর কিরীটি ধরি, ফেলিতেছ টানি’
ধূলিতলে। বীণা-তারে করাঘাত হানি’
সারদার, কী সুর বাজাতে চাহ গুণী?
যত সুর আর্তনাদ হ’য়ে ওঠে শুনি!
প্রভাতে উঠিয়া কালি শুনিনু, সানাই
বাজিছে করুণ সুরে! যেন আসে নাই
আজো কা’রা ঘরে ফিরে! কাঁদিয়া কাঁদিয়া
ডাকিছে তাদেরে যেন ঘরে ‘সানাইয়া’!
বধূদের প্রাণ আজ সানা’য়ের সুরে
ভেসে যায় যথা আজ প্রিয়তম দূরে
আসি আসি করিতেছে! সখী বলে, ‘বল্‌
মুছিলি কেন লা আঁখি, মুছিলি কাজল?….
শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই
‘ আয় আয়’ কাঁদিতেছে তেমনি সানাই।
ম্লানমুখী শেফালিকা পড়িতেছে ঝরি’
বিধবার হাসি সম-স্নিগ্ধ গন্ধে ভরি’!
নেচে ফেরে প্রজাপতি চঞ্চল পাখায়
দুরন্ত নেশায় আজি, পুষ্প-প্রগল্‌ভায়
চুম্বনে বিবশ করি’! ভোমোরার পাখা
পরাগে হলুদ আজি, অঙ্গে মধু মাখা।
উছলি’ উঠিছে যেন দিকে দিকে প্রাণ!
আপনার অগোচরে গেয়ে উঠি গান
আগমনী আনন্দের! অকারণে আঁখি
পু’রে আসে অশ্রু-জলে! মিলনের রাখী
কে যেন বাঁধিয়া দেয় ধরণীর সাথে!
পুষ্পঞ্জলি ভরি’ দু’টি মাটি মাখা হাতে
ধরণী এগিয়ে আসে, দেয় উপহার।
ও যেন কনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী আমার!-
সহসা চমকি’ উঠি! হায় মোর শিশু
জাগিয়া কাঁদিছ ঘরে, খাওনি ক’ কিছু
কালি হ’তে সারাদিন তাপস নিষ্ঠুর,
কাঁদ’ মোর ঘরে নিত্য তুমি ক্ষুধাতুর!
পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার,
দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে!-মোর অধিকার
আনন্দের নাহি নাহি! দারিদ্র্য অসহ
পুত্র হ’য়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ
আমার দুয়ার ধরি! কে বাজাবে বাঁশি?
কোথা পাব আনন্দিত সুন্দরের হাসি?
কোথা পাব পুষ্পাসব?-ধুতুরা-গেলাস
ভরিয়া করেছি পান নয়ন-নির্যাস!….
আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই,
ও যেন কাঁদিছে শুধু-নাই কিছু নাই!

পসারিনী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      

পসারিনী, ওগো পসারিনী,
কেটেছে সকালবেলা হাটে হাটে লয়ে বিকিকিনি।
        ঘরে ফিরিবার খনে
        কী জানি কী হল মনে,
                বসিলি গাছের ছায়াতলে--
        লাভের জমানো কড়ি
        ডালায় রহিল পড়ি,
                ভাবনা কোথায় ধেয়ে চলে।

      এই মাঠ, এই রাঙা ধূলি,
অঘ্রানের-রৌদ্র-লাগা চিক্কণ কাঁঠালপাতাগুলি
        শীতবাতাসের শ্বাসে
        এই শিহরন ঘাসে--
                কী কথা কহিল তোর কানে।
বহুদূর নদীজলে
           আলোকের রেখা ঝলে,
                   ধ্যানে তোর কোন্‌ মন্ত্র আনে।

      সৃষ্টির প্রথম স্মৃতি হতে
সহসা আদিম স্পন্দ সঞ্চরিল তোর রক্তস্রোতে।
           তাই এ তরুতে তৃণে
           প্রাণ আপনারে চিনে
                   হেমন্তের মধ্যাহ্নের বেলা--
           মৃত্তিকার খেলাঘরে
           কত যুগযুগান্তরে
                   হিরণে হরিতে তোর খেলা।

      নিরালা মাঠের মাঝে বসি
সাম্প্রতের আবরণ মন হতে গেল দ্রুত খসি।
           আলোকে আকাশে মিলে
           যে-নটন এ নিখিলে
                   দেখ তাই আঁখির সম্মুখে,
           বিরাট কালের মাঝে
           যে ওঙ্কারধ্বনি বাজে
                   গুঞ্জরি উঠিল তোর বুকে।

      যত ছিল ত্বরিত আহ্বান
পরিচিত সংসারের দিগন্তে হয়েছে অবসান।
           বেলা কত হল, তার
           বার্তা নাহি চারিধার,
                   না কোথাও কর্মের আভাস।
           শব্দহীনতার স্বরে
           খররৌদ্র ঝাঁ ঝাঁ করে,
                   শূন্যতার উঠে দীর্ঘশ্বাস।

      পসারিনী, ওগো পসারিনী,
ক্ষণকাল-তরে আজি ভুলে গেলি যত বিকিকিনি।
           কোথা হাট, কোথা ঘাট,
           কোথা ঘর, কোথা বাট,
                   মুখর দিনের কলকথা--
           অনন্তের বাণী আনে
           সর্বাঙ্গে সকল প্রাণে
                   বৈরাগ্যের স্তব্ধ ব্যাকুলতা।

কাণ্ডারী হুশিয়ার

কাজী নজরুল ইসলাম
দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!

তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান!
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে, নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার!!

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!

গিরি-সংকট, ভীরু যাত্রীরা, গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ
কান্ডারী! তুমি ভূলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
‘করে হানাহানি, তবু চল টানি’, নিয়াছ যে মহাভার!

কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙ্গালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।

ফাঁসির মঞ্চে যারা গেয়ে গেল জীবনের জয়গান,
আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রান?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!

কৃষ্ণনগর; ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩

কুলি মজুর

 কাজী নজরুল ইসলাম

দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,
বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্‌?
রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা?-ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি হঁটে আছে লিখা।
তুমি জান না ক’, কিন- পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!
আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
তুমি শুয়ে র’বে তেতালার পরে আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে!
সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে
এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে!
তারি পদরজ অঞ্জলি করি’ মাথায় লইব তুলি’,
সকলের সাথে পথে চলি’ যার পায়ে লাগিয়াছে ধূলি!
আজ নিখিলের বেদনা -আর্ত পীড়িতের মাখি’ খুন,
লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ!
আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্‌ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!
সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়-ক আমাদের এই ঘরে,
মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়-ক ঝ’রে।
সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,
উর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান

Sunday, September 11, 2016

বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি,
              সে কি সহজ গান।
       সেই সুরেতে জাগব আমি
              দাও মোরে সেই কান।
                                  ভুলব না আর সহজেতে,
                                  সেই প্রাণে মন উঠবে মেতে
                                  মৃত্যুমাঝে ঢাকা আছে
                                         যে অন্তহীন প্রাণ।

       সে ঝড় যেন সই আনন্দে
              চিত্তবীণার তারে
       সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্ত
              নাচাও যে ঝংকারে।
                                  আরাম হতে ছিন্ন ক'রে
                                  সেই গভীরে লও গো মোরে
                                  অশান্তির অন্তরে যেথায়
                                         শান্তি সুমহান।

ভুলি কেমনে আজো যে মনে বেদনা , নজরুলগীতি

"ভুলি কেমনে আজো যে মনে বেদনা সনে রহিল আকা।
আজো সজনী দিন রজনী সে বিনে গনি তেমনি ফাঁকা।।


আগে মন করলে চুরি, মর্মে শেষে হানলে ছুরি,
এত শঠতা এত যে ব্যাথা তবু যেন তা মধুতে মাখা।।


চকোরী দেখলে চাদে দূর হতে সই আজো কাদে,
আজো বাদলে ঝুলন ঝোলে তেমনি জলে চলে বলাকা।।


বকুলের তলায় দোদুল কাজলা মেয়ে কুড়োয় লো ফুল,
চলে নাগরী কাখে গাগরী চরন ভারী কোমর বাকা।।


তরুরা রিক্ত-পাতা, আসলো লো তাই ফুল বারতা,
ফুলেরা গলে ঝরেছে বলে ভরেছে ফলে বিটপী- শাখা।।


ডালে তোর হানলে আঘাত দিস্ রে কবি ফুল-সওগাত,
ব্যথা-মুকুলে অলি না ছুঁলে বনে কি দুলে ফুল-পতাকা।।"

হে মোর চিত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।
হেথায় দাঁড়ায়ে দু বাহু বাড়ায়ে নমি নরদেবতারে--
উদার ছন্দে, পরমানন্দে বন্দন করি তাঁরে।
ধ্যানগম্ভীর এই-যে ভূধর,   নদী-জপমালা-ধৃত প্রান্তর,
হেথায় নিত্য হেরো পবিত্র ধরিত্রীরে--
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর   

কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা।
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন--
শক-হুন-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন।
পশ্চিমে আজি খুলিয়াছে দ্বার,   সেথা হতে সবে আনে উপহার,
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে--
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ॥
    
এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার।
এসো হে পতিত, হোক অপনীত সব অপমানভার।
মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা,   মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা
সবার-পরশে-পবিত্র-করা তীর্থনীরে--
আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ॥

নিমন্ত্রণ, জসীম উদ্দিন

নিমন্ত্রণ

জসীম উদ্দিন



তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
ছোট গাঁওখানি- ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,
কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া;
ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী
পারের খবর টানাটানি করি;
বিনাসুতি মালা গাথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।
তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে, ছোট সে কাজল গাঁয়,
গলাগলি ধরি কলা বন; যেন ঘিরিয়া রয়েছে তায়।
সরু পথ খানি সুতায় বাঁধিয়া
দূর পথিকেরে আনিছে টানিয়া,
বনের হাওয়ায়, গাছের ছায়ায়, ধরিয়া রাখিবে তায়,
বুকখানি তার ভরে দেবে বুঝি, মায়া আর মমতায়!
তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে - নরম ঘাসের পাতে
চম্বন রাখি অধরখানিতে মেজে লয়ো নিরালাতে।
তেলাকুচা - লতা গলায় পরিয়া
মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া,
হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে,
তোমার গায়ের রংখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে।
তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে, তোমারে সঙ্গে করি
নদীর ওপারে চলে যাই তবে লইয়া ঘাটের তরী।
মাঠের যত না রাখাল ডাকিয়া
তোর সনে দেই মিতালী করিয়া
ঢেলা কুড়িইয়া গড়ি ইমারত সারা দিনমান ধরি,
সত্যিকারের নগর ভুলিয়া নকল নগর গড়ি।
তুমি যদি যাও - দেখিবে সেখানে মটর লতার সনে,
সীম আর সীম - হাত বাড়াইলে মুঠি ভরে সেই খানে।
তুমি যদি যাও সে - সব কুড়ায়ে
নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,
খাব আর যত গেঁঢো - চাষীদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,
হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব দুইজনে।
তুমি যদি যাও - শালুক কুড়ায়ে, খুব - খুব বড় করে,
এমন একটি গাঁথিব মালা যা দেখনি কাহারো করে,
কারেও দেব না, তুমি যদি চাও
আচ্ছা না হয় দিয়ে দেব তাও,
মালাটিরে তুমি রাখিও কিন্তু শক্ত করিয়া ধরে,
ও পাড়াব সব দুষ্ট ছেলেরা নিতে পারে জোর করে;
সন্ধ্যা হইলে ঘরে ফিরে যাব, মা যদি বকিতে চায়,
মতলব কিছু আঁটির যাহাতে খুশী তারে করা যায়!
লাল আলোয়ানে ঘুঁটে কুড়াইয়া
বেঁধে নিয়ে যাব মাথায় করিয়া
এত ঘুষ পেয়ে যদি বা তাহার মন না উঠিতে চায়,
বলিব - কালিকে মটরের শাক এনে দেব বহু তায়।
খুব ভোর ক’রে উঠিতে হইবে, সূয্যি উঠারও আগে,
কারেও ক’বি না, দেখিস্ পায়ের শব্দে কেহ না জাগে
রেল সড়কের ছোট খাদ ভরে
ডানকিনে মাছ কিলবিল করে;
কাদার বাঁধন গাঁথি মাঝামাঝি জল সেঁচে আগে ভাগে
সব মাছগুলো কুড়ায়ে আনিব কাহারো জানার আগে।
ভর দুপুরেতে এক রাশ কাঁদা আর এক রাশ মাছ,
কাপড়ে জড়ায়ে ফিরিয়া আসিব আপন বাড়ির কাছ।
ওরে মুখ - পোড়া ওরে রে বাঁদর।
গালি - ভরা মার অমনি আদর,
কতদিন আমি শুনি নারে ভাই আমার মায়ের পাছ;
যাবি তুই ভাই, আমাদের গাঁয়ে যেথা ঘন কালো গাছ।
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।
ঘন কালো বন - মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়।
গাছের ছায়ায় বনের লতায়
মোর শিশুকাল লুকায়েছে হায়!
আজি সে - সব সরায়ে সরায়ে খুজিয়া লইব তায়,
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গায়।
তোরে নিয়ে যাব আমাদের গাঁয়ে ঘন-পল্লব তলে
লুকায়ে থাকিস্, খুজে যেন কেহ পায় না কোনই বলে।
মেঠো কোন ফুল কুড়াইতে যেয়ে,
হারাইয়া যাস্ পথ নাহি পেয়ে;
অলস দেহটি মাটিতে বিছায়ে ঘুমাস সন্ধ্যা হলে,
সারা গাঁও আমি খুজিয়া ফিরিব তোরি নাম বলে বলে।

প্রাক্তন প্রেমিকার কাছে লেখা চিঠি

প্রিয় একসময়ের প্রেমিকা,
সময়ের সাথে মানুষের গন্ধটাও বদলায় । একসময় অনেক দুরথেকে
বলতে পারতাম তুমি আশেপাশে আছো । আমি কুকুর পুষি হয়তো তার কাছ থেকে এই গুনটি পেয়েছি । কুকুর যেমন একই এলাকার বাসিন্দাকে দূর থেকে গন্ধ শুকে বলতে পারে ও তার বন্ধু না শত্র“ তেমনি আমিও চিনতাম তোমার পায়ের শব্দ, গন্ধ । আজ কিন্তু সেটা কেমন যেন অপরিচিত মনে হয় ! আজ অনেকদিন পরে তোমায় দেখলাম সত্যি চিনতে পারিনি ! কোন ইন্দ্রিয় বলেনি তোমাকে চেনে ! হয়তো তারা সেই তোমাকে পায়নি , তাই আমাকে কিছু বলে নি । কি করবো বল , যে তোমার সাথে কথা বলে কথা শেষ হতো না আজ কোন কথাই মুখে আসেনি !
তুমি আশেপাশে আসার সাথে সাথেকেমন যেন উৎকট গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছিল , বমি আসছিল ,। পরপুরুষে ছুঁলে বুঝি এমন হয় ! তুমি ধারেরকাছে যতক্ষণ ছিলে আমি শ্বাস নিতে পারিনি , আমার অক্সিজেন কে যেন কেড়ে নিয়েছিল । তোমাকে দেখে আমার খুব ঘৃণা লাগছিল , সাথে বমি। মনে হয়েছিল কে এই দুরাত্মা , পাপী , বারবনিতা , রক্ষিতা । বের করে দাও একে এখান থকে , এ এই সুন্দর পরিবেশ নষ্ট করছে !
সত্যি এমন ঘৃণা জাগবে আমি জানিনি ! অথচ ভেবেছিলাম তোমার সাথে
কোনদিন দেখা হলে চোখের জল হয়তো বাঁধ মানবে না । সময় কত নিষ্ঠুর না ! বদলে দিয়েছে দুজনকে । সত্যি তোমার প্রতি আজ আমার কোন ভালবাসা নাই , যা আছে তা শুধু ঘৃণা । তুমি প্রতারক ! বি সি এস ক্যাডারের কাছে বিক্রি হয়েছিলে , আবিষ্কার করেছিলাম দুজনকে হলের সামনে ,সেদিন দুনিয়াটা আমার অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল । অনেক কষ্টে সে দিন গুলোর কথা ভুলেছি । অনেক রাগ হয়েছে তোমার উপর, মনে হয়েছে দুজনকে পিটিয়ে সোজা করে দি । আমার ক্যা¤পাসে আমার চোখের সামনে ঘুরেছ , কিছু বলি নি । কিন্তু আজ ! দিন সবার একভাবে যায় না । আজ তুমি ভিখারি আমি রাজা ! প্রতিশোধ নিতে পারি কিন্তু নেব না । দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে ! পন্যা , পতিতা কোথাকার !
দ্যাখো, সে দিন আমি তোমার জন্য কেঁদেছি আজ কত ঘৃণা করি তোমায়।
যা হোক ভালো থেকো , আমি তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছি অনেক আগেই !

পাখির ফিরে আসা

ফিরে এল পাখি আমার । আজ পাঁচ বছর পরে । স্বামীর সাথে বনিবনা হয়নি তাই আমার কাছে চলে এলো । একদিন বলেছিলাম ,'' আমার দরজা সারাজীবন তোমার জন্য খোলা থাকবে , জীবনের যে কোন সময় আমার কাছে এসো , আমি তোমাকে গ্রহণ করব ।'' তাই সে আজ আমার কাছে ভরসা খুজতে এলো । অথচ একদিন আমার কাছে ভরসা না পেয়ে ওই লোকের জন্য আমাকে কষ্ট দিয়ে চলে গিয়েছিল ।
তোমাকে নিয়ে আমি সেন্ট মারটিন যাবো ? গিয়েছিলে তোমার স্বামীকে নিয়ে ওখানে ? জিজ্ঞেস করবো না কোনদিন । কারন আমি আর তুমি ক্যাম্পাসে কত ঘুরেছি , সেই সব জায়গায় তুমি তোমার স্বামীকে নিয়ে ঘুরেছ । আমার কথা মনেও পড়েনি তখন ।
আচ্ছা, কি করেছিল লোকটা ? চলে যাওয়ার সময় বলেছিলে,'' লোকটার বয়স ৩৮ । তাকে আমি সৎ মনে করি না । সে এই পর্যন্ত এসেছে নিশ্চয়ই প্রেম , সেক্স এগুলো করেছেই । এতে আমি কিছু মনে করি করি না ।''
অথচ তুমি আমার প্রথম প্রেম ছিলে ! কি পার্থক্য ছিল লোকটার আর আমার ? অনেক তাইনা ? সে বি সি এস ক্যাডার আর আমি মাত্র ছাত্র । আমার একটা দোষ তুমি ক্ষমা করতে না অথচ তার বেলায় সাতখুন মাপ । মর্যাদার জন্যই আমাকে ছেড়েছিলে । মর্যাদা পেলে কোথায় ? মর্যাদা পাওনি তাই ফিরে এসেছ ?
কিন্তু আমিতো সেই আমি নাই । তুমি দুঃখ দিয়েছিলে বোলেই পৃথিবীটা দেখতে বেরিয়েছি । দেখেছি পৃথিবীতে তোমার চেয়েও সুন্দর মেয়ে আছে । তোমার চেয়েও সুন্দর করে মানুষ কথা বোলতে পারে । দেখেছি যারা আমার মত ছাত্র আর জন্য কি করবে না করবে হতবুদ্ধ হয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছে , ভাইয়া ভাইয়া বলে গলা শুকিয়েছে ।
তোমাকে এখন আর তাদের পাশে ঠাই দিয়ে পারি কই । লোভে পড়েছিলে , ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়া , বি সি এস ক্যাডার এর বউ , কি মর্যাদা তাই না ! দামি দামি সুন্দর সুন্দর পোশাক , কি সুখ! আহা ! সে সুন্দর করে কোর্ট শার্ট পরে ক্যাম্পাসে আসে ! এর আমি ভার্সিটির বিভিন্ন র‍্যালিতে পাওয়া ফ্রি টিশার্ট পরেই জীবন কাটাই , ক্লাসে যাই, ঘুরে বেড়াই । তাই ছেড়ে গিয়েছিলে ?
শেষে একটা কথাই বলি । তুমি ছেড়েছিলে তাই পৃথিবী তার সৌন্দর্যে আমাকে মাতিয়েছে । দুহাত ভরে শূন্যতাকে সে পূর্ণ করেছে । আজ ফিরে এসেছ , কিন্তু তোমাকে দেয়ার মতো জায়গা কই বলো ? আমি যে সব কিছু পৃথিবীকে দিয়ে দিয়েছি !

পাখির প্রতি প্রেমপত্র

প্রেম করে বিয়ে করতে সাহস লাগে মেয়ে , তোমার মতো ভীরু মেয়ের দ্বারা তা হবে না ।
হু , তোমার দ্বারা হবে ?
হবে না মানে ? চলো আজই বিয়ে করবো ।
এভাবে আমি বিয়ে করবো না । মা বাবা কি বলবে ? পাড়া প্রতিবেশী কি বলবে ? আমাদের পাঁচ বোনের কেউ প্রেম করে বিয়ে করি নি । আর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি , মা বাবা কতো কষ্ট করে টাকা পাঠায় , আমি তাদের মনে কষ্ট দিতে পারবো না ।
বাল , প্রেম করার সময় মনে ছিল না ? আমার চার বছর নষ্ট করে এখন উনি কাহিনী জুড়েছেন ।
দেখো রাজীব , মা কে আমি কষ্ট দিতে পারবো না । মা এমনিতেই হাইপ্রেশারের রোগী । একথা শুনলে উনি মারাই যাবেন ।
কেন , তোমার ফুফা করেছিল , তার মা মারা গিয়েছিল ? তোমার বাবা করেছিল , তাঁর মা মারা গিয়েছিল ?
দ্যাখো , ওনাদের কথা আলাদা ।
বালের আলাদা । মেজাজ খারাপ কর না । মা কি বিলবে , বোনেরা কি বলবে তার ভয়ে উনি প্রেমের সমাধি দিবেন । আরে পাখি , লোকের তো আর কাজ নাই , আমাদের কথা নিয়ে ওনাদের ঘুম হারাম করবে । লোকে প্রেমের বিয়েকে ভালোই বলে । মুখে যাই বলুক না কেন । প্রেম করে কয়জন তার প্রেমিকাকে বিয়ে করতে পেরেছে ? সবাই চায় প্রেমের জয় হোক । আমিও চাই প্রেমিক প্রেমিকার মিলন হোক । ক্যাম্পাসে ছেলেরা অনেক সময় প্রেমিক জুটিকে র‍্যাগ দেয় । আমি ওদের বলি ,‘’দ্যাক ভাই , প্রেম স্বর্গীয় , ওদের মিলন হোক । তোমরাও তোমাদের প্রেমিকাকে পাও জীবন সাথী করে । ওদের সুখে থাকতে দাও । কিছু কিছু ছেলের প্রিয়তমা এতো সাহসী যে সবকিছু তুচ্ছ করে প্রেমিকের কাছে ছুটে আসে । এমনইতো চাই । আমি পারি নাই বলে তাতে কি ? ওরা তো পারছে । ‘’ শুনে ওরা চুপ করে মন খারাপ করে চলে যায় । হয়তো ওদের মনে হয়ে যায় , একটু সাহসের অভাবে একদিন সে তার প্রিয়াকে হারিয়েছে । হয়তো তাকে শুনতে হয়েছে ,’’আপনি অতো সাহসী না ।‘’
বলবেই তো , পটানোর কথা সব । বিয়ে করবে খাওয়াবে কি ? আমার ইচ্ছা মন্ত্রীদের মেয়েদের যেমন ধুমধাম করে দিয়ে হয় আমার তেমনি হবে । ৩২ ভরি সোনার অলঙ্কার আমার গায়ে থাকবে । আর মা বাবাকে কষ্ট দিয়ে বিয়ে করলে ওনারা অভিশাপ দেবে । ওই ছেলেকে বিয়ে করলে মা বাবা অনেক খুশি হবে । আমি সুখে না থাকলেও সুখী খাকার ভান করবো । দেখেছো ছেলেটা ম্যাজিস্ট্রেট শুনে ওনারা কতো খুশি হয়েছেন । আমি ওনাদের মনে কষ্ট দিতে পারবো না । তুমি আমায় ক্ষমা করো ।
এরপর তোমার বিয়ে আর আমার একাএকা পথ চলা শুরু । আজ দশ বছর পরে জিজ্ঞেস করছি কেমন আছো তুমি ? এখন একটু সাহসী হয়েছ কি ? বিয়েটা আমায় করলেই পারতে । আর হ্যা, প্রোমোশন পেয়ে পেয়ে তোমার স্বামীর উপরর পোস্টাই আমার । মানে এখন আসবে আমার কাছে । আসলে যোগাযোগ করো , কেমন ?

বাসন্তীর প্রতি প্রেমপত্র

আমার একটা পেয়ারা প্রেম ছিল । পেয়ারা প্রেম মানে হচ্ছে, সে প্রতিদিন গোসল করার সময় পেয়ারা নিয়ে আসতো আর দুজনে নদীর পাশে বসে খেতাম আর আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম । সে ছিল এলাকার সেরা সুন্দরী । এলাকার বড় ভাইরা আমার সাথে কথা বলতো না , আমি তার সাথে প্রেম করি বলে । প্রেম বোলতে এমন ছিল যে , সে এতো সুন্দর ছিল যে আমি তাকে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম । বিনিময়ে সে আমাকে প্রতিদিন টমেটো , তেতুল , পেয়ারা , বরই খাওয়াত । আমাকে ছাড়া পাগলীটা কিছু বুজত না । প্রতিদিন বিকেলে ওদের খেতের শশা , আখ তুলতে আমাকে নিয়ে যেত । আখ খেতে গেলেই ওর পায়ে কি যেন ব্যাথা হতো , হাটতেই পারতনা । ওকে ওটুকু কোলে করে পার করতে হতো । আর বুকের ভেতর সে গরম নিঃশ্বাস ফেলত । আমি কোথায় আছি সে ঠিক জানতো আর সেখানে চলে আসতো । দোতালার ঘরে একা আছি হঠাৎ দেখি সে এসে হাজির , নতুন জামা পরে আয়নার সামনে ভাব নিচ্ছি পেছনে দেখি সে । কোন অনুষ্ঠানে গেলে ছেলেরা ওর পিছু নিত আর আমি ছেলেদের সাথে ঝগড়া মারামারি করতাম । আর অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আসার সময় সে হাটতেই পারতোনা , হাত ধরে কাঁধের উপর মাথা রেখে দুলতে দুলতে আসতো । মাঠে খেলতে গেলে ও আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে লাফাত আর দৌড়াত, আর সে কি হাসি । আজো সে হাসে তবে আমার বুকের ভেতর লুকিয়ে লুকিয়ে । আর আমি ওকে অনেক ভালবাসি । ও যে আমার সব ।

Saturday, September 10, 2016

যৌবনের গান , কাজী নজরুল ইসলাম


বার্ধক্য তাহাই—যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে, মৃত্যুকে আঁকড়িয়া পড়িয়া থাকে, বৃদ্ধ তাহারাই—যাহারা মায়াচ্ছন্ন নব মানবের অভিনব জয় যাত্রার শুধু বোঝা নয়, বিঘ্ন; শতাব্দীর নব যাত্রীর চলার ছন্দে ছন্দ মিলাইয়া যাহারা কুচকাওয়াজ করিতে জানে না, পারে না; যাহারা জীব হইয়াও জড়; যাহারা অটল সংস্কারের পাষাণস্তূপ আঁকড়িয়া পড়িয়া আছে। বৃদ্ধ তাহারাই যাহারা নব অরুণোদয় দেখিয়া নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে দ্বার রুদ্ধ করিয়া পড়িয়া থাকে। আলোক-পিয়াসী প্রাণ চঞ্চল শিশুদের কল কোলাহলে যাহারা বিরক্ত হইয়া অভিসম্পাত করিতে থাকে, জীর্ণ পুঁতি চাপা পড়িয়া যাহাদের নাভিশ্বাস বহিতেছে, অতি জ্ঞানের অগ্নিমান্দ্যে যাহারা আজ কঙ্কালসার—বৃদ্ধ তাহারাই। ইহাদের ধর্মই বার্ধক্য। বার্ধককে সব সময় বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। বহু যুবককে দেখিয়াছি যাহাদের যৌবনের উর্দির নিচে বার্ধক্যের কঙ্কাল মূর্তি। আবার বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি যাঁহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন। তরুণ নামের জয়-মুকুট শুধু তাহারই যাহার শক্তি অপরিমাণ, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ় মধ্যাহ্নের মার্তণ্ডপ্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অটল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে। তারুণ্য দেখিয়াছি আরবের বেদুইনদের মাঝে, তারুণ্য দেখিয়াছি মহাসমরে সৈনিকের মুখে, কালাপাহাড়ের অসিতে, কামাল-করিম-মুসোলিনি-সানইয়াৎ লেনিনের শক্তিতে। যৌবন দেখিয়াছি তাহাদের মাঝে—যাহারা বৈমানিকরূপে অনন্ত আকাশের সীমা খুঁজিতে গিয়া প্রাণ হারায়, আবিষ্কারকরূপে নব-পৃথিবীর সন্ধানে গিয়া আর ফিরে না, গৌরীশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষদেশ অধিকার করিতে গিয়া যাহারা তুষার-ঢাকা পড়ে, অতল সমুদ্রের নীল মঞ্জুষার মণি আহরণ করিতে গিয়া সলিলসমাধি লাভ করে, মঙ্গলগ্রহে, চন্দ্রলোকে যাইবার পথ আবিষ্কার করিতে গিয়া নিরুদ্দেশ হইয়া যায়। পবন-গতিকে পশ্চাতে ফেলিয়া যাহারা উড়িয়া যাইতে চায়, নব নব গ্রহ-নক্ষত্রের সন্ধান করিতে করিতে যাহাদের নয়ন-মণি নিভিয়া যায়—যৌবন দেখিয়াছি সেই দুরন্তদের মাঝে। যৌবনের মাতৃরূপ দেখিয়াছি—শব বহন করিয়া যখন সে যায় শ্মশানঘাটে, গোরস্থানে, অনাহারে থাকিয়া যখন সে অন্ন পরিবেশন করে দুর্ভিক্ষ বন্যা-পীড়িতদের মুখে, বন্ধুহীন রোগীর শয্যাপার্শ্বে যখন সে রাত্রির পর রাত্রি জাগিয়া পরিচর্যা করে, যখন সে পথে পথে গান গাহিয়া ভিখারী সাজিয়া দুর্দশাগ্রস্তদের জন্য ভিক্ষা করে, যখন দুর্বলের পাশে বল হইয়া দাঁড়ায়, হতাশের বুকে আশা জাগায়।
ইহাই যৌবন, এই ধর্ম যাহাদের তাহারাই তরুণ। তাহাদের দেশ নাই, জাতি নাই, অন্য ধর্ম নাই। দেশ-কাল-জাতি-ধর্মের সীমার ঊর্ধ্বে ইহাদের সেনানিবাস। আজ আমরা—মুসলিম তরুণেরা— যেন অকুণ্ঠিত চিত্তে মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি—ধর্ম আমাদের ইসলাম, কিন্তু প্রাণের ধর্ম আমাদের তারুণ্য, যৌবন। আমরা সকল দেশের, সকল জাতির, সকল ধর্মের, সকল কালের। আমরা মুরিদ যৌবনের। এই জাতি-ধর্ম-কালকে অতিক্রম করিতে পারিয়াছে যাঁহাদের যৌবন, তাঁহারাই আজ মহামানব, মহাত্মা, মহাবীর। তাহাদিগকে সকল দেশের সকল ধর্মের সকল লোক সমান শ্রদ্ধা করে।
পথ-পার্শ্বের ধর্ম-অট্টালিকা আজ পড় পড় হইয়াছে, তাহাকে ভাঙিয়া ফেলিয়া দেওয়াই আমাদের ধর্ম, ঐ জীর্ণ অট্টালিকা চাপা পড়িয়া বহু মানবের মৃত্যুর কারণ হইতে পারে। যে-ঘর আমাদের আশ্রয় দান করিয়াছে, তাহা যদি সংস্কারাতীত হইয়া আমাদেরই মাথায় পড়িবার উপক্রম করে, তাহাকে ভাঙিয়া নতুন করিয়া গড়িবার দুঃসাহস আছে একা তরুণেরই। খোদার দেওয়া এই পৃথিবীর নিয়ামত হইতে যে নিজেকে বঞ্চিত রাখিল, সে যত মোনাজাতই করুক, খোদা তাহা কবুল করিবেন না। খোদা হাত দিয়াছেন বেহেশত ও বেহেশতি চিজ অর্জন করিয়া লইবার জন্য, ভিখারীর মতো হাত তুলিয়া ভিক্ষা করিবার জন্য নয়। আমাদের পৃথিবী আমরা আমাদের মনের মতো করিয়া গড়িয়া লইব। ইহাই হউক তরুণের সাধনা।

Thursday, September 1, 2016

পূজারিণী কাজী নজরুল ইসলাম

পূজারিণী
কাজী নজরুল ইসলাম

এত দিনে অবেলায়-

প্রিয়তম!

ধূলি-অন্ধ ঘূর্ণি সম

দিবাযামী

যবে আমি

নেচে ফিরি র”ধিরাক্ত মরণ-খেলায়-

এ দিনে অ-বেলায়

জানিলাম, আমি তোমা’ জন্মে জন্মে চিনি।

পূজারিণী!

ঐ কন্ঠ, ও-কপোত- কাঁদানো রাগিণী,

ঐ আখি, ঐ মুখ,

ঐ ভুর”, ললাট, চিবুক,

ঐ তব অপরূপ রূপ,

ঐ তব দোলো-দোলো গতি-নৃত্য দুষ্ট দুল রাজহংসী জিনি’-

চিনি সব চিনি।



তাই আমি এতদিনে

জীবনের আশাহত ক্লান- শুষ্ক বিদগ্ধ পুলিনে

মূর্ছাতুর সারা প্রাণ ভ’রে

ডাকি শুকু ডাকি তোমা’

প্রিয়তমা!

ইষ্ট মম জপ-মালা ঐ তব সব চেয়ে মিষ্ট নাম ধ’রে!

তারি সাথে কাঁদি আমি-

ছিন্ন-কন্ঠে কাঁদি আমি, চিনি তোমা’, চিনি চিনি চিনি,

বিজয়িনী নহ তুমি-নহ ভিখারিনী,

তুমি দেবী চির-শুদ্ধ তাপস-কুমারী, তুমি মম চির-পূজারিণী!

যুগে যুগে এ পাষাণে বাসিয়াছ ভালো,

আপনারে দাহ করি, মোর বুকে জ্বালায়েছ আলো,

বারে বারে করিয়াছ তব পূজা-ঋণী।

চিনি প্রিয়া চিনি তোমা’ জন্মে জন্মে চিনি চিনি চিনি!

চিনি তোমা’ বারে বারে জীবনের অস–ঘাটে, মরণ-বেলায়,

তারপর চেনা-শেষে

তুমি-হারা পরদেশে

ফেলে যাও একা শুণ্য বিদায়-ভেলায়!



দিনানে-র প্রানে- বসি’ আঁখি-নীরে তিনি’

আপনার মনে আনি তারি দূর-দূরানে-র স্মৃতি-

মনে পড়ে-বসনে-র শেষ-আশা-ম্লান মৌন মোর আগমনী সেই নিশি,

যেদিন আমার আঁখি ধন্য হ’ল তব আখি-চাওয়া সনে মিশি।

তখনো সরল সুখী আমি- ফোটেনি যৌবন মম,

উন্মুখ বেদনা-মুখী আসি আমি ঊষা-সম

আধ-ঘুমে আধ-জেগে তখনো কৈশোর,

জীবনের ফোটো-ফোটো রাঙা নিশি-ভোর,

বাধা বন্ধ-হারা

অহেতুক নেচে-চলা ঘূর্ণিবায়ু-পারা

দুরন- গানের বেগ অফুরন- হাসি

নিয়ে এনু পথ-ভোলা আমি অতি দূর পরবাসী।

সাথে তারি

এনেছিনু গৃহ-হারা বেদনার আঁখি-ভরা বারি।

এসে রাতে-ভোরে জেগে গেয়েছিনু জাগরণী সুর-

ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছিলে তুমি কাছে এসেছিলে,

মুখ-পানে চেয়ে মোর সকর”ণ হাসি হেসেছিলে,-

হাসি হেরে কেঁদেছিনু-‘তুমি কার পোষাপাখী কান-ার বিধুর?’

চোখে তব সে কী চাওয়া! মনে হ’ল যেন

তুমি মোর ঐ কন্ঠ ঐ সুর-

বিরহের কান্না-ভারাতুর

বনানী-দুলানো,

দখিনা সমীরে ডাকা কুসুম-ফোটানো বন-হরিণী-ভুলানো

আদি জন্মদিন হ’তে চেন তুমি চেন!

তারপর-অনাদরে বিদায়ের অভিমান-রাঙা

অশ্র”-ভাঙা-ভাঙা

ব্যথা-গীত গেয়েছিনু সেই আধ-রাতে,

বুঝি নাই আমি সেই গান-গাওয়া ছলে

কারে পেতে চেয়েছিনু চিরশূন্য মম হিয়া-তলে-

শুধু জানি, কাঁচা-ঘুমে জাগা তব রাগ-অর”ণ-আঁখি-ছায়া

লেগেছিল মম আঁখি-পাতে।

আরো দেখেছিনু, ঐ আঁখির পলকে

বিস্ময়-পুলক-দীপ্তি ঝলকে ঝলকে

ঝ’লেছিল, গ’লেছিল গাঢ় ঘন বেদানার মায়া,-

কর”ণায় কেঁপে কেঁপে উঠেছিল বিরহিণী

অন্ধকার-নিশীথিনী-কায়া।



তৃষাতুর চোখে মোর বড় যেন লেগেছিল ভালো

পূজারিণী! আঁখি-দীপ-জ্বালা তব সেই সিগ্ধ সকর”ণ আলো।



তারপর-গান গাওয়া শেষে

নাম ধ’রে কাছে বুঝি ডেকেছিনু হেসে।

অমনি কী গ’র্জে-উঠা র”দ্ধ অভিমানে

(কেন কে সে জানে)

দুলি’ উঠেছিল তব ভুর”-বাঁধা সি’র আঁখি-তরী,

ফুলে উঠেছিল জল, ব্যথা-উৎস-মুখে তাহা ঝরঝর

প’ড়েছিল ঝরি’!

একটু আদরে এত অভিমানে ফুলে-ওঠা, এত আঁখি-জল,

কোথা পেলি ওরে কা’র অনাদৃতা ওরে মোর ভিখারিনী

বল্‌ মোরে বল্‌ ।

এই ভাঙা বুকে

ঐ কান্না-রাঙা মুখ থুয়ে লাজ-সুখে

বল্‌ মোরে বল্‌-

মোরে হেরি’ কেন এত অভিমান?

মোর ডাকে কেন এত উথলায় চোখে তব জল?

অ-চেনা অ-জানা আমি পথের পথিক

মোরে হেরে জলে পুরে ওঠে কেন এত ঐ বালিকার আঁখি অনিমিখ?

মোর পানে চেয়ে সবে হাসে,

বাঁধা-নীড় পুড়ে যায় অভিশপ্ত তপ্ত মোর শ্বাসে;

মণি ভেবে কত জনে তুলে পরে গলে,

মণি যবে ফণী হয়ে বিষ-দগ্ধ-মুখে

দংশে তার বুকে,

অমনি সে দলে পদতলে!

বিশ্ব যারে করে ভয় ঘৃণা অবহেলা,

ভিখরিণী! তারে নিয়ে এ কি তব অকর”ণ খেলা?

তারে নিয়ে এ কি গূঢ় অভিমান? কোন্‌ অধিকারে

নাম ধ’রে ডাকটুকু তা’ও হানে বেদনা তোমারে?

কেউ ভালোবাসে নাই? কেই তোমা’ করেনি আদর?

জন্ম-ভিখারিনী তুমি? তাই এত চোখে জল, অভিমানী কর”ণা-কাতর!

নহে তা’ও নহে-

বুকে থেকে রিক্ত-কন্ঠে কোন্‌ রিক্ত অভিমানী কহে-

‘নহে তা’ও নহে।’

দেখিয়াছি শতজন আসে এই ঘরে,

কতজন না চাহিতে এসে বুকে করে,

তবু তব চোখে-মুখে এ অতৃপ্তি, এ কী স্নেহ-ক্ষুধা

মোরে হেলে উছলায় কেন তব বুক-ছাপা এত প্রীতি সুধা?

সে রহস্য রাণী!

কেহ নাহি জানে-

তুমি নাহি জান-

আমি নাহি জানি।

চেনে তা প্রেম, জানে শুধু প্রাণ-

কোথা হ’তে আসে এত অকারণে প্রাণে প্রাণে বেদনার টান!



নাহি বুঝিয়াও আমি সেদিন বুঝিনু তাই, হে অপরিচিতা!

চির-পরিচিতা তুমি, জন্ম জন্ম ধ’রে অনাদৃতা সীতা!

কানন-কাঁদানো তুমি তাপস-বালিকা

অনন- কুমারী সতী, তব দেব-পূজার থালিকা

ভাঙিয়াছি যুগে যুগে, ছিঁড়িয়াছি মালা

খেলা-ছলে; চিন-মৌনা শাপভ্রষ্টা ওগো দেববালা!

নীরবে স’য়েছ সবি-

সহজিয়া! সহজে জেনেছ তুমি, তুমি মোর জয়লক্ষ্মী, আমি তব কবি।

তারপর-নিশি শেষে পাশে ব’সে শুনেছিনু তব গীত-সুর

লাজে-আধ-বাধ-বাধ শঙ্কিত বিধুর;

সুর শুনে হ’ল মনে- ক্ষণে ক্ষণে

মনে-পড়ে-পড়ে না হারা কন্ঠ যেন

কেঁদে কেঁদে সাধে, ‘ওগো চেন মোরে জন্মে জন্মে চেন।’

মথুরায় গিয়ে শ্যাম, রাধিকার ভুলেছিল যবে,

মনে লাগে- এই সুর গীত-রবে কেঁদেছিল রাধা,

অবহেলা-বেঁধা-বুক নিয়ে এ যেন রে অতি-অন-রালে ললিতার কাঁদা

বন-মাঝে একাকিনী দময়ন-ী ঘুরে ঘুরে ঝুরে,

ফেলে-যাওয়া নাথে তার ডেকেছিল ক্লান–কন্ঠে এই গীত-সুরে।

কানে- প’ড়ে মনে

বনলতা সনে

বিষাদিনী শকুন-লা কেঁদেছিল এই সুরে বনে সঙ্গোপনে।

হেম-গিরি-শিরে

হারা-সতী উমা হ’য়ে ফিরে

ডেকেছিল ভোলানাথে এমনি সে চেনা কন্ঠে হায়,

কেঁদেছিল চির-সতী পতি প্রিয়া প্রিয়ে তার পেতে পুনরায়!-

চিনিলাম বুঝিলাম সবি-

যৌবন সে জাগিল না, লাগিল না মর্মে তাই গাঢ় হ’য়ে তব মুখ-ছবি।



তবু তব চেনা কন্ঠ মম কন্ঠ -সুর

রেখে আমি চ’লে গেনু কবে কোন্‌ পল্লী-পথে দূরে!–

দু’দিন না যেতে যেতে এ কি সেই পুণ্য গোমতীর কূলে

প্রথম উঠিল কাঁদি’ অপরূপ ব্যথা-গন্ধ নাভি-পদ্ম-মুলে!



খুঁজে ফিরি কোথা হ’তে এই ব্যাথা-ভারাতুর মদ-গন্ধ আসে-

আকাশ বাতাস ধরা কেঁপে কেঁপে ওঠে শুধু মোর তপ্ত ঘন দীর্ঘশ্বাসে।

কেঁদে ওঠে লতা-পাতা,

ফুল পাখি নদীজল

মেঘ বায়ু কাঁদে সবি অবিরল,

কাঁদে বুকে উগ্রসুখে যৌবন-জ্বালায়-জাগা অতৃপ্ত বিধাতা!

পোড়া প্রাণ জানিল না কারে চাই,

চীৎকারিয়া ফেরে তাই-‘কোথা যাই,

কোথা গেলে ভালোবাসাবাসি পাই?

হু-হু ক’রে ওঠে প্রাণ, মন করে উদাস-উদাস,

মনে হয়-এ নিখিল যৌবন-আতুর কোনো প্রেমিকের ব্যথিত হুতাশ!

চোখ পুরে’ লাল নীল কত রাঙা, আবছায়া ভাসে, আসে-আসে-

কার বক্ষ টুটে

মম প্রাণ-পুটে

কোথা হ’তে কেন এই মৃগ-মদ-গন্ধ-ব্যথা আসে?

মন-মৃগ ছুটে ফেরে; দিগন-র দুলি’ ওঠে মোর ক্ষিপ্ত হাহাকার-ত্রাসে!

কস’রী হরিণ-সম

আমারি নাভির গন্ধ খুঁজে ফেলে গন্ধ-অন্ধ মন-মৃগ মম!

আপনারই ভালোবাসা

আপনি পিইয়া চাহে মিটাইতে আপনার আশা!

অনন- অগস-্য-তৃষাকুল বিশ্ব-মাগা যৌবন আমার

এক সিন্ধু শুষি’ বিন্দু-সম, মাগে সিন্ধু আর!

ভগবান! ভগবান! এ কি তৃষ্ণা অনন- অপার!

কোথা তৃপ্তি? তৃপ্তি কোথা? কোথা মোর তৃষ্ণা-হরা প্রেম-সিন্ধু

অনাদি পাথার!

মোর চেয়ে স্বে”ছাচারী দুরন- দুর্বার!

কোথা গেলে তারে পাই,

যার লাগি’ এত বড় বিশ্বে মোর নাই শানি- নাই!

ভাবি আর চলি শুধু, শুধু পথ চলি,

পথে কত পথ-বালা যায়,

তারি পাছে হায় অন্ধ-বেগে ধায়

ভালোবাসা-ক্ষুধাতুর মন,

পিছু ফিরে কেহ যদি চায়, ‘ভিক্ষা লহ’ ব’লে কেহ আসে দ্বার-পাশে।

প্রাণ আরো কেঁদে ওঠে তাতে,

গুমরিয়া ওঠে কাঙালের লজ্জাহীন গুর” বেদনাতে!

প্রলয়-পয়োধি-নীরে গর্জে-ওঠা হুহুঙ্কার-সম

বেদনা ও অভিমানে ফুলে’ ফুলে’ দুলে’ ওঠে ধূ-ধূ

ক্ষোভ-ক্ষিপ্ত প্রাণ-শিখা মম!

পথ-বালা আসে ভিক্ষা-হাতে,

লাথি মেরে চুর্ণ করি গর্ব তার ভিক্ষা-পাত্র সাথে।

কেঁদে তারা ফিরে যায়, ভয়ে কেহ নাহি আসে কাছে;

‘অনাথপিন্ডদ’-সম

মহাভিক্ষু প্রাণ মম

প্রেম-বুদ্ধ লাগি’ হায় দ্বারে দ্বারে মহাভিক্ষা যাচে,

“ভিক্ষা দাও, পুরবাসি!

বুদ্ধ লাগি’ ভিক্ষা মাগি, দ্বার হ’তে প্রভু ফিরে যায় উপবাসী!’’

কত এল কত গেল ফিরে,-

কেহ ভয়ে কেহ-বা বিস্ময়ে!

ভাঙা-বুকে কেহ,

কেহ অশ্র”-নীরে-

কত এল কত গেল ফিরে!

আমি যাচি পূর্ণ সমর্পণ,

বুঝিতে পারে না তাহা গৃহ-সুখী পুরনারীগণ।

তারা আসে হেসে;

শেষে হাসি-শেষে

কেঁদে তারা ফিরে যায়

আপনার গৃহ স্নেহ”ছায়ে।

বলে তারা, “হে পথিক! বল বল তব প্রাণ কোন্‌ ধন মাগে?

সুরে তব এত কান্না, বুকে তব কা’র লাগি এত ক্ষুধা জাগে?

কি যে চাই বুঝে না ক’ কেহ,

কেহ আনে প্রাণ মম কেহ- বা যৌবন ধন,

কেহ রূপ দেহ।

গর্বিতা ধনিকা আসে মদমত্তা আপনার ধনে

আমারে বাঁধিতে চাহে রূপ-ফাঁদে যৌবনের বনে।….

সর্ব ব্যর্থ, ফিরে চলে নিরাশায় প্রাণ

পথে পথে গেয়ে গেয়ে গান-

“কোথা মোর ভিখারিনী পূজারিণী কই?

যে বলিবে-‘ভালোবেসে সন্ন্যাসিনী আমি

ওগো মোর স্বামি!

রিক্তা আমি, আমি তব গরবিনী,বিজয়িনী নই!”

মর” মাঝে ছুটে ফিরি বৃথা,

হু হু ক’রে জ্ব’লে ওঠে তৃষা-

তারি মাঝে তৃষ্ণা-দগ্ধ প্রাণ

ক্ষণেকের তরে কবে হারাইল দিশা।

দূরে কার দেখা গেল হাতছানি যেন-

ডেকে ডেকে সে-ও কাঁদে-

‘আমি নাথ তব ভিখারিনী,

আমি তোমা’ চিনি,

তুমি মোরে চেন।’

বুঝিনু না, ডাকিনীর ডাক এ যে,

এ যে মিথ্যা মায়া,

জল নহে, এ যে খল, এ যে ছল মরীচিকা ছাষা!

‘ভিক্ষা দাও’ ব’লে আমি এনু তার দ্বারে,

কোথা ভিখারিনী? ওগো এ যে মিথ্যা মায়াবিনী,

ঘরে ডেকে মারে।

এ যে ক্রূর নিষাদের ফাঁদ,

এ যে ছলে জিনে নিতে চাহে ভিখারীর ঝুলির প্রসাদ।

হ’ল না সে জয়ী,

আপনার জালে প’ড়ে আপনি মরিল মিথ্যাময়ী।

কাঁটা-বেঁধা রক্ত মাথা প্রাণ নিয়ে এনু তব পুরে,

জানি নাই ব্যথাহত আমার ব্যথায়

তখনো তোমার প্রাণ পুড়ে।

তবু কেন কতবার মনে যেন হ’ত,

তব স্নিগ্ধ মদিন পরশ মুছে নিতে পারে মোর

সব জ্বালা সব দগ্ধ ক্ষত।

মনে হ’ত প্রাণে তব প্রাণে যেন কাঁদে অহরহ-

‘হে পথিক! ঐ কাঁটা মোরে দাও, কোথা তব ব্যথা বাজে

কহ মোরে কহ!

নীরব গোপন তুমি মৌন তাপসিনী,

তাই তব চির-মৌন ভাষা

শুনিয়াও শুনি নাই, বুঝিয়াও বুঝি নাই ঐ ক্ষুদ্র চাপা-বুকে

কাঁদে কত ভালোবাসা আশা!

এরি মাঝে কোথা হ’তে ভেসে এল মুক্তধারা মা আমার

সে ঝড়ের রাতে,

কোলে তুলে নিল মোরে, শত শত চুমা দিল সিক্ত আঁখি-পাতে।

কোথা গেল পথ-

কোথা গেল রথ-

ডুবে গেল সব শোক-জ্বালা,

জননীর ভালোবাসা এ ভাঙা দেউলে যেন দুলাইল দেয়ালীর আলা!

গত কথা গত জন্ম হেন

হারা-মায়ে পেয়ে আমি ভুলে গেনু যেন।

গৃহহারা গৃহ পেনু, অতি শান- সুখে

কত জন্ম পরে আমি প্রাণ ভ’রে ঘুমাইনু মুখ থুয়ে জননীর বুকে।

শেষ হ’ল পথ-গান গাওয়া,

ডেকে ডেকে ফিরে গেল হা-হা স্বরে পথসাথী তুফানের হাওয়া।

আবার আবার বুঝি ভুলিলাম পথ-

বুঝি কোন্‌ বিজয়িনী-দ্বার প্রানে- আসি’ বাধা পেল পার্থ-পথ-রথ।

ভুলে গেনু কারে মোর পথে পথ খোঁজা,-

ভুলে গেনু প্রাণ মোর নিত্যকাল ধ’রে অভিসারী

মাগে কোন্‌ পূজা,

ভুলে গেনু যত ব্যথা শোক,-

নব সুখ-অশ্র”ধারে গ’লে গেল হিয়া, ভিজে গেল অশ্র”হীন চোখ।

যেন কোন্‌ রূপ-কমলেতে মোর ডুবে গেল আঁখি,

সুরভিতে মেতে উঠে বুক,

উলসিয়া বিলসিয়া উথলিল প্রাণে

এ কী ব্যগ্র উগ্র ব্যথা-সুখ।

বাঁচিয়া নূতন ক’রে মরিল আবার

সীধু-লোভী বাণ-বেঁধা পাখী।….

…. ভেসে গেল রক্তে মোর মন্দিরের বেদী-

জাগিল না পাষাণ-প্রতিমা,

অপমানে দাবানল-সম তেজে

র”খিয়া উঠিল এইবার যত মোর ব্যথা-অর”নিমা।

হুঙ্কারিয়া ছুটিলাম বিদ্রোহের রক্ত-অশ্বে চড়ি’

বেদনার আদি-হেতু স্রষ্টা পানে মেঘ অভ্রভেদী,

ধূমধ্বজ প্রলয়ের ধূমকেতু-ধুমে

হিংসা হোমশিখা জ্বালি’ সৃজিলাম বিভীষিকা স্নেহ-মরা শুষ্ক মর”ভূমে।

…. এ কি মায়া! তার মাঝে মাঝে

মনে হ’ত কতদূরে হ’তে, প্রিয় মোর নাম ধ’রে যেন তব বীণা বাজে!

সে সুদূর গোপন পথের পানে চেয়ে

হিংসা-রক্ত-আঁখি মোর অশ্র”রাঙা বেদনার রসে যেত ছেয়ে।

সেই সুর সেই ডাক স্মরি’ স্মরি’

ভুলিলাম অতীতের জ্বালা,

বুঝিলাম তুমি সত্য-তুমি আছে,

অনাদৃতা তুমি মোর, তুমি মোরে মনে প্রাণে যাচ’,

একা তুমি বনবালা

মোর তরে গাঁথিতেছ মালা

আপনার মনে

লাজে সঙ্গোপনে।

জন্ম জন্ম ধ’রে চাওয়া তুমি মোর সেই ভিখারিনী।

অন-রের অগ্নি-সিন্ধু ফুল হ’য়ে হেসে উঠে কহে- ‘চিনি, চিনি।

বেঁচে ওঠ্‌ মরা প্রাণ! ডাকে তোরে দূর হ’তে সেই-

যার তরে এত বড় বিশ্বে তোর সুখ-শানি- নেই!’

তারি মাঝে

কাহার ক্রন্দন-ধ্বনি বাজে?

কে যেন রে পিছু ডেকে চীৎকারিয়া কয়-

‘বন্ধু এ যে অবেলায়! হতভাগ্য, এ যে অসময়!

শুনিনু না মানা, মানিনু না বাধা,

প্রাণে শুধু ভেসে আসে জন্মন-র হ’তে যেন বিরহিণী ললিতার কাঁদা!

ছুটে এনু তব পাশে

উর্ধ্বশ্বাসে,

মৃত্যু-পথ অগ্নি-রথ কোথা প’ড়ে কাঁদে, রক্ত-কেতু গেল উড়ে পুড়ে,

তোমার গোপান পূজা বিশ্বের আরাম নিয়া এলো বুক জুড়ে।



তারপর যা বলিব হারায়েছি আজ তার ভাষা;

আজ মোর প্রাণ নাই, অশ্র” নাই, নাই শক্তি আশা।

যা বলিব আজ ইহা গান নহে, ইহা শুধু রক্ত-ঝরা প্রাণ-রাঙা

অশ্র”-ভাঙা ভাষা।

ভাবিতেছ, লজ্জাহীন ভিখারীর প্রাণ-

সে-ও চাহে দেওয়ার সম্মান!

সত্য প্রিয়া, সত্য ইহা, আমিও তা স্মরি’

আজ শুধু হেসে হেসে মরি!

তবু শুধু এইটুকু জেনে রাখো প্রিয়তমা, দ্বার হ’তে দ্বারান-রে

ব্যর্থ হ’য়ে ফিরে

এসেছিনু তব পাশে, জীবনের শেষ চাওয়া চেয়েছিনু তোমা’,

প্রাণের সকল আশা সব প্রেম ভালোবাসা দিয়া

তোমারে পূজিয়াছিনু, ওগো মোর বে-দরদী পূজারিণী প্রিয়া!

ভেবেছিনু, বিশ্ব যারে পারে নাই তুমি নেবে তার ভার হেসে,

বিশ্ব-বিদ্রোহীরে তুমি করিবে শাসন

অবহেলে শুধু ভালোবাসে।

ভেবেছিনু, দুর্বিনীত দুর্জয়ীরে জয়ের গরবে

তব প্রাণে উদ্ভাসিবে অপরূপ জ্যোতি, তারপর একদিন

তুমি মোর এ বাহুতে মহাশক্তি সঞ্চারিয়া

বিদ্রোহীর জয়লক্ষ্মী হবে।

ছিল আশা, ছিল শক্তি, বিশ্বটারে টেনে

ছিঁড়ে তব রাঙা পদতলে ছিন্ন রাঙা পদ্মসম পূজা দেব এনে!

কিন’ হায়! কোথা সেই তুমি? কোথা সেই প্রাণ?

কোথা সেই নাড়ী-ছেঁড়া প্রাণে প্রাণে টান?

এ-তুমি আজ সে-তুমি তো নহ;

আজ হেরি-তুমিও ছলনাময়ী,

তুমিও হইতে চাও মিথ্যা দিয়া জয়ী!

কিছু মোরে দিতে চাও, অন্য তরে রাখ কিছু বাকী,-

দুর্ভাগিনী! দেখে হেসে মরি! কারে তুমি দিতে চাও ফাঁকি?

মোর বুকে জাগিছেন অহরহ সত্য ভগবান,

তাঁর দৃষ্টি বড় তীক্ষ্ন, এ দৃষ্টি যাহারে দেখে,

তন্ন তন্ন ক’রে খুঁজে দেখে তার প্রাণ!

লোভে আজ তব পূজা কলুষিত, প্রিয়া,

আজ তারে ভুলাইতে চাহ,

যারে তুমি পূজেছিলে পূর্ণ মন-প্রাণ সমর্পিয়া।

তাই আজি ভাবি, কার দোষে-

অকলঙ্ক তব হৃদি-পুরে

জ্বলিল এ মরণের আলো কবে প’শে?

তবু ভাবি, এ কি সত্য? তুমিও ছলনাময়ী?

যদি তাই হয়, তবে মায়াবিনী অয়ি!

ওরে দুষ্ট, তাই সত্য হোক।

জ্বালো তবে ভালো ক’রে জ্বালো মিথ্যালোক।

আমি তুমি সুর্য চন্দ্র গ্রহ তারা

সব মিথ্যা হোক;

জ্বালো ওরে মিথ্যাময়ী, জ্বালো তবে ভালো ক’রে

জ্বালো মিথ্যালোক।

তব মুখপানে চেয়ে আজ

বাজ-সম বাজে মর্মে লাজ;

তব অনাদর অবহেলা স্মরি’ স্মরি’

তারি সাথে স্মরি’ মোর নির্লজ্জতা

আমি আজ প্রাণে প্রাণে মরি।

মনে হয়-ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি, ‘মা বসুধা দ্বিধা হও!

ঘৃণাহত মাটিমাখা ছেলেরে তোমার

এ নির্লজ্জ মুখ-দেখা আলো হ’তে অন্ধকারে টেনে লও!

তবু বারে বারে আসি আশা-পথ বাহি’,

কিন’ হায়, যখনই ও-মুখ পানে চাহি-

মনে হয়,-হায়,হায়, কোথা সেই পূজারিণী,

কোথা সেই রিক্ত সন্ন্যাসিনী?

এ যে সেই চির-পরিচিত অবহেলা,

এ যে সেই চির-ভাবহীন মুখ!

পূর্ণা নয়, এ যে সেই প্রাণ নিয়ে ফাঁকি-

অপমানে ফেটে যায় বুক!

প্রাণ নিয়া এ কি নিদার”ণ খেলা খেলে এরা হায়!

রক্ত-ঝরা রাঙা বুক দ’লে অলক্তক পরে এরা পায়!

এর দেবী, এরা লোভী, এরা চাহে সর্বজন-প্রীতি!

ইহাদের তরে নহে প্রেমিকের পূর্ণ পূজা, পূজারীর পূর্ণ সমর্পণ,

পূজা হেরি’ ইহাদের ভীর” বুকে তাই জাগে এত সত্য-ভীতি।

নারী নাহি হ’তে চায় শুধু একা কারো,

এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো!

ইহাদের অতিলোভী মন

একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়,

যাচে বহু জন।..

যে-পূজা পূজিনি আমি স্রষ্টা ভগবানে,

যারে দিনু সেই পূজা সে-ই আজি প্রতারণা হানে।

বুঝিয়াছি, শেষবার ঘিরে আসে সাথী মোর মৃত্যু-ঘন আঁখি,

রিক্ত প্রাণ তিক্ত সুখে হুঙ্কারিয়া উঠে তাই,

কার তরে ওরে মন, আর কেন পথে পথে কাঁদি?

জ্বলে’ ওঠ্‌ এইবার মহাকাল ভৈরবের নেত্রজ্বালা সম ধ্বক্‌-ধ্বক্‌,

হাহাকার-করতালি বাজা! জ্বালা তোর বিদ্রোহের রক্তশিখা অনন- পাবক।

আন্‌ তোর বহ্নি-রথ, বাজা তোর সর্বনাশী তূরী!

হান্‌ তোর পরশু-ত্রিশুল! ধ্বংস কর্‌ এই মিথ্যাপুরী।

রক্ত-সুধা-বিষ আন্‌ মরণের ধর টিপে টুটি!

এ মিথ্যা জগৎ তোর অভিশপ্ত জগদ্দল চাপে হোক্‌ কুটি-কুটি!

কন্ঠে আজ এত বিষ, এত জ্বালা,

তবু, বালা,

থেকে থেকে মনে পড়ে-

যতদিন বাসিনি তোমারে ভালো,

যতদিন দেখিনি তোমার বুক-ঢাকা রাগ-রাঙা আলো,

তুমি ততদিনই

যেচেছিলে প্রেম মোর, ততদিনই ছিলে ভিখারিনী।

ততদিনই এতটুকু অনাদরে বিদ্রোহের তিক্ত অভিমানে

তব চোখে উছলাতো জল, ব্যথা দিত তব কাঁচা প্রাণে;

একটু আদর-কণা একটুকু সোহাগের লাগি’

কত নিশি-দিন তুমি মনে কর, মোর পাশে রহিয়াছ জাগি’,

আমি চেয়ে দেখি নাই; তারই প্রতিশোধ

নিলে বুঝি এতদিনে! মিথ্যা দিয়ে মোরে জিনে

অপমান ফাঁকি দিয়ে করিতেছ মোর শ্বাস-রোধ!

আজ আমি মরণের বুক থেকে কাঁদি-

অকর”ণা! প্রাণ নিয়ে এ কি মিথ্যা অকর”ণ খেলা!

এত ভালোবেসে শেষে এত অবহেলা

কেমনে হানিতে পার, নারী!

এ আঘাত পুর”ষের,

হানিতে এ নির্মম আঘাত, জানিতাম মোরা শুধু পুর”ষেরা পারি।

ভাবিতাম, দাগহীন অকলঙ্ক কুমারীর দান,

একটি নিমেষ মাঝে চিরতরে আপনারে রিক্ত করি’ দিয়া

মন-প্রাণ লভে অবসান।

ভুল, তাহা ভুল

বায়ু শুধু ফোটায় কলিকা, অলি এসে হ’রে নেয় ফুল!

বায়ু বলী, তার তরে প্রেম নহে প্রিয়া!

অলি শুধু জানে ভালো কেমনে দলিতে হয় ফুল-কলি-হিয়া!

পথিক-দখিনা-বায়ু আমি চলিলাম বসনে-র শেষে

মৃত্যুহীন চিররাত্রি নাহি-জানা দেশে!

বিদায়ের বেলা মোর ক্ষণে ক্ষণে ওঠে বুকে আনন্দাশ্র” ভরি’

কত সুখী আমি আজ সেই কথা স্মরি’!

আমি না বাসিতে ভালো তুমি আগে বেসেছিলে ভালো,

কুমারী-বুকের তব সব স্নিগ্ধ রাগ-রাঙা আলো

প্রথম পড়িয়াছিল মোর বুকে-মুখে-

ভুখারীর ভাঙা বুকে পুলকের রাঙা বান ডেকে যায় আজ সেই সুখে!

সেই প্রীতি, সেই রাঙা সুখ-স্মৃতি স্মরি’

মনে হয় এ জীবন এ জনম ধন্য হ’ল- আমি আজ তৃপ্ত হ’য়ে মরি!

না-চাহিতে বেসেছিলে ভালো মোরে তুমি-শুধু তুমি,

সেই সুখে মৃত্যু-কৃষ্ণ অধর ভরিয়া

আজ আমি শতবার ক’রে তব প্রিয় নাম চুমি’।

মোরে মনে প’ড়ে-

একদা নিশীথে যদি প্রিয়

ঘুশায়ে কাহারও বুকে অকারণে বুক ব্যথা করে,

মনে ক’রো, মরিয়াছে, গিয়াছে আপদ!

আর কভু আসিবে না

উগ্র সুখে কেহ তব চুমিতে ও-পদ-কোকনদ!

মরিয়াছে-অশান- অতৃপ্ত চির-স্বার্থপর লোভী,-

অমর হইয়া আছে-র’বে চিরদিন

তব প্রেমে মৃত্যুঞ্জয়ী

ব্যথা-বিষে নীলকণ্ঠ কবি!