Thursday, September 1, 2016

পূজারিণী কাজী নজরুল ইসলাম

পূজারিণী
কাজী নজরুল ইসলাম

এত দিনে অবেলায়-

প্রিয়তম!

ধূলি-অন্ধ ঘূর্ণি সম

দিবাযামী

যবে আমি

নেচে ফিরি র”ধিরাক্ত মরণ-খেলায়-

এ দিনে অ-বেলায়

জানিলাম, আমি তোমা’ জন্মে জন্মে চিনি।

পূজারিণী!

ঐ কন্ঠ, ও-কপোত- কাঁদানো রাগিণী,

ঐ আখি, ঐ মুখ,

ঐ ভুর”, ললাট, চিবুক,

ঐ তব অপরূপ রূপ,

ঐ তব দোলো-দোলো গতি-নৃত্য দুষ্ট দুল রাজহংসী জিনি’-

চিনি সব চিনি।



তাই আমি এতদিনে

জীবনের আশাহত ক্লান- শুষ্ক বিদগ্ধ পুলিনে

মূর্ছাতুর সারা প্রাণ ভ’রে

ডাকি শুকু ডাকি তোমা’

প্রিয়তমা!

ইষ্ট মম জপ-মালা ঐ তব সব চেয়ে মিষ্ট নাম ধ’রে!

তারি সাথে কাঁদি আমি-

ছিন্ন-কন্ঠে কাঁদি আমি, চিনি তোমা’, চিনি চিনি চিনি,

বিজয়িনী নহ তুমি-নহ ভিখারিনী,

তুমি দেবী চির-শুদ্ধ তাপস-কুমারী, তুমি মম চির-পূজারিণী!

যুগে যুগে এ পাষাণে বাসিয়াছ ভালো,

আপনারে দাহ করি, মোর বুকে জ্বালায়েছ আলো,

বারে বারে করিয়াছ তব পূজা-ঋণী।

চিনি প্রিয়া চিনি তোমা’ জন্মে জন্মে চিনি চিনি চিনি!

চিনি তোমা’ বারে বারে জীবনের অস–ঘাটে, মরণ-বেলায়,

তারপর চেনা-শেষে

তুমি-হারা পরদেশে

ফেলে যাও একা শুণ্য বিদায়-ভেলায়!



দিনানে-র প্রানে- বসি’ আঁখি-নীরে তিনি’

আপনার মনে আনি তারি দূর-দূরানে-র স্মৃতি-

মনে পড়ে-বসনে-র শেষ-আশা-ম্লান মৌন মোর আগমনী সেই নিশি,

যেদিন আমার আঁখি ধন্য হ’ল তব আখি-চাওয়া সনে মিশি।

তখনো সরল সুখী আমি- ফোটেনি যৌবন মম,

উন্মুখ বেদনা-মুখী আসি আমি ঊষা-সম

আধ-ঘুমে আধ-জেগে তখনো কৈশোর,

জীবনের ফোটো-ফোটো রাঙা নিশি-ভোর,

বাধা বন্ধ-হারা

অহেতুক নেচে-চলা ঘূর্ণিবায়ু-পারা

দুরন- গানের বেগ অফুরন- হাসি

নিয়ে এনু পথ-ভোলা আমি অতি দূর পরবাসী।

সাথে তারি

এনেছিনু গৃহ-হারা বেদনার আঁখি-ভরা বারি।

এসে রাতে-ভোরে জেগে গেয়েছিনু জাগরণী সুর-

ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছিলে তুমি কাছে এসেছিলে,

মুখ-পানে চেয়ে মোর সকর”ণ হাসি হেসেছিলে,-

হাসি হেরে কেঁদেছিনু-‘তুমি কার পোষাপাখী কান-ার বিধুর?’

চোখে তব সে কী চাওয়া! মনে হ’ল যেন

তুমি মোর ঐ কন্ঠ ঐ সুর-

বিরহের কান্না-ভারাতুর

বনানী-দুলানো,

দখিনা সমীরে ডাকা কুসুম-ফোটানো বন-হরিণী-ভুলানো

আদি জন্মদিন হ’তে চেন তুমি চেন!

তারপর-অনাদরে বিদায়ের অভিমান-রাঙা

অশ্র”-ভাঙা-ভাঙা

ব্যথা-গীত গেয়েছিনু সেই আধ-রাতে,

বুঝি নাই আমি সেই গান-গাওয়া ছলে

কারে পেতে চেয়েছিনু চিরশূন্য মম হিয়া-তলে-

শুধু জানি, কাঁচা-ঘুমে জাগা তব রাগ-অর”ণ-আঁখি-ছায়া

লেগেছিল মম আঁখি-পাতে।

আরো দেখেছিনু, ঐ আঁখির পলকে

বিস্ময়-পুলক-দীপ্তি ঝলকে ঝলকে

ঝ’লেছিল, গ’লেছিল গাঢ় ঘন বেদানার মায়া,-

কর”ণায় কেঁপে কেঁপে উঠেছিল বিরহিণী

অন্ধকার-নিশীথিনী-কায়া।



তৃষাতুর চোখে মোর বড় যেন লেগেছিল ভালো

পূজারিণী! আঁখি-দীপ-জ্বালা তব সেই সিগ্ধ সকর”ণ আলো।



তারপর-গান গাওয়া শেষে

নাম ধ’রে কাছে বুঝি ডেকেছিনু হেসে।

অমনি কী গ’র্জে-উঠা র”দ্ধ অভিমানে

(কেন কে সে জানে)

দুলি’ উঠেছিল তব ভুর”-বাঁধা সি’র আঁখি-তরী,

ফুলে উঠেছিল জল, ব্যথা-উৎস-মুখে তাহা ঝরঝর

প’ড়েছিল ঝরি’!

একটু আদরে এত অভিমানে ফুলে-ওঠা, এত আঁখি-জল,

কোথা পেলি ওরে কা’র অনাদৃতা ওরে মোর ভিখারিনী

বল্‌ মোরে বল্‌ ।

এই ভাঙা বুকে

ঐ কান্না-রাঙা মুখ থুয়ে লাজ-সুখে

বল্‌ মোরে বল্‌-

মোরে হেরি’ কেন এত অভিমান?

মোর ডাকে কেন এত উথলায় চোখে তব জল?

অ-চেনা অ-জানা আমি পথের পথিক

মোরে হেরে জলে পুরে ওঠে কেন এত ঐ বালিকার আঁখি অনিমিখ?

মোর পানে চেয়ে সবে হাসে,

বাঁধা-নীড় পুড়ে যায় অভিশপ্ত তপ্ত মোর শ্বাসে;

মণি ভেবে কত জনে তুলে পরে গলে,

মণি যবে ফণী হয়ে বিষ-দগ্ধ-মুখে

দংশে তার বুকে,

অমনি সে দলে পদতলে!

বিশ্ব যারে করে ভয় ঘৃণা অবহেলা,

ভিখরিণী! তারে নিয়ে এ কি তব অকর”ণ খেলা?

তারে নিয়ে এ কি গূঢ় অভিমান? কোন্‌ অধিকারে

নাম ধ’রে ডাকটুকু তা’ও হানে বেদনা তোমারে?

কেউ ভালোবাসে নাই? কেই তোমা’ করেনি আদর?

জন্ম-ভিখারিনী তুমি? তাই এত চোখে জল, অভিমানী কর”ণা-কাতর!

নহে তা’ও নহে-

বুকে থেকে রিক্ত-কন্ঠে কোন্‌ রিক্ত অভিমানী কহে-

‘নহে তা’ও নহে।’

দেখিয়াছি শতজন আসে এই ঘরে,

কতজন না চাহিতে এসে বুকে করে,

তবু তব চোখে-মুখে এ অতৃপ্তি, এ কী স্নেহ-ক্ষুধা

মোরে হেলে উছলায় কেন তব বুক-ছাপা এত প্রীতি সুধা?

সে রহস্য রাণী!

কেহ নাহি জানে-

তুমি নাহি জান-

আমি নাহি জানি।

চেনে তা প্রেম, জানে শুধু প্রাণ-

কোথা হ’তে আসে এত অকারণে প্রাণে প্রাণে বেদনার টান!



নাহি বুঝিয়াও আমি সেদিন বুঝিনু তাই, হে অপরিচিতা!

চির-পরিচিতা তুমি, জন্ম জন্ম ধ’রে অনাদৃতা সীতা!

কানন-কাঁদানো তুমি তাপস-বালিকা

অনন- কুমারী সতী, তব দেব-পূজার থালিকা

ভাঙিয়াছি যুগে যুগে, ছিঁড়িয়াছি মালা

খেলা-ছলে; চিন-মৌনা শাপভ্রষ্টা ওগো দেববালা!

নীরবে স’য়েছ সবি-

সহজিয়া! সহজে জেনেছ তুমি, তুমি মোর জয়লক্ষ্মী, আমি তব কবি।

তারপর-নিশি শেষে পাশে ব’সে শুনেছিনু তব গীত-সুর

লাজে-আধ-বাধ-বাধ শঙ্কিত বিধুর;

সুর শুনে হ’ল মনে- ক্ষণে ক্ষণে

মনে-পড়ে-পড়ে না হারা কন্ঠ যেন

কেঁদে কেঁদে সাধে, ‘ওগো চেন মোরে জন্মে জন্মে চেন।’

মথুরায় গিয়ে শ্যাম, রাধিকার ভুলেছিল যবে,

মনে লাগে- এই সুর গীত-রবে কেঁদেছিল রাধা,

অবহেলা-বেঁধা-বুক নিয়ে এ যেন রে অতি-অন-রালে ললিতার কাঁদা

বন-মাঝে একাকিনী দময়ন-ী ঘুরে ঘুরে ঝুরে,

ফেলে-যাওয়া নাথে তার ডেকেছিল ক্লান–কন্ঠে এই গীত-সুরে।

কানে- প’ড়ে মনে

বনলতা সনে

বিষাদিনী শকুন-লা কেঁদেছিল এই সুরে বনে সঙ্গোপনে।

হেম-গিরি-শিরে

হারা-সতী উমা হ’য়ে ফিরে

ডেকেছিল ভোলানাথে এমনি সে চেনা কন্ঠে হায়,

কেঁদেছিল চির-সতী পতি প্রিয়া প্রিয়ে তার পেতে পুনরায়!-

চিনিলাম বুঝিলাম সবি-

যৌবন সে জাগিল না, লাগিল না মর্মে তাই গাঢ় হ’য়ে তব মুখ-ছবি।



তবু তব চেনা কন্ঠ মম কন্ঠ -সুর

রেখে আমি চ’লে গেনু কবে কোন্‌ পল্লী-পথে দূরে!–

দু’দিন না যেতে যেতে এ কি সেই পুণ্য গোমতীর কূলে

প্রথম উঠিল কাঁদি’ অপরূপ ব্যথা-গন্ধ নাভি-পদ্ম-মুলে!



খুঁজে ফিরি কোথা হ’তে এই ব্যাথা-ভারাতুর মদ-গন্ধ আসে-

আকাশ বাতাস ধরা কেঁপে কেঁপে ওঠে শুধু মোর তপ্ত ঘন দীর্ঘশ্বাসে।

কেঁদে ওঠে লতা-পাতা,

ফুল পাখি নদীজল

মেঘ বায়ু কাঁদে সবি অবিরল,

কাঁদে বুকে উগ্রসুখে যৌবন-জ্বালায়-জাগা অতৃপ্ত বিধাতা!

পোড়া প্রাণ জানিল না কারে চাই,

চীৎকারিয়া ফেরে তাই-‘কোথা যাই,

কোথা গেলে ভালোবাসাবাসি পাই?

হু-হু ক’রে ওঠে প্রাণ, মন করে উদাস-উদাস,

মনে হয়-এ নিখিল যৌবন-আতুর কোনো প্রেমিকের ব্যথিত হুতাশ!

চোখ পুরে’ লাল নীল কত রাঙা, আবছায়া ভাসে, আসে-আসে-

কার বক্ষ টুটে

মম প্রাণ-পুটে

কোথা হ’তে কেন এই মৃগ-মদ-গন্ধ-ব্যথা আসে?

মন-মৃগ ছুটে ফেরে; দিগন-র দুলি’ ওঠে মোর ক্ষিপ্ত হাহাকার-ত্রাসে!

কস’রী হরিণ-সম

আমারি নাভির গন্ধ খুঁজে ফেলে গন্ধ-অন্ধ মন-মৃগ মম!

আপনারই ভালোবাসা

আপনি পিইয়া চাহে মিটাইতে আপনার আশা!

অনন- অগস-্য-তৃষাকুল বিশ্ব-মাগা যৌবন আমার

এক সিন্ধু শুষি’ বিন্দু-সম, মাগে সিন্ধু আর!

ভগবান! ভগবান! এ কি তৃষ্ণা অনন- অপার!

কোথা তৃপ্তি? তৃপ্তি কোথা? কোথা মোর তৃষ্ণা-হরা প্রেম-সিন্ধু

অনাদি পাথার!

মোর চেয়ে স্বে”ছাচারী দুরন- দুর্বার!

কোথা গেলে তারে পাই,

যার লাগি’ এত বড় বিশ্বে মোর নাই শানি- নাই!

ভাবি আর চলি শুধু, শুধু পথ চলি,

পথে কত পথ-বালা যায়,

তারি পাছে হায় অন্ধ-বেগে ধায়

ভালোবাসা-ক্ষুধাতুর মন,

পিছু ফিরে কেহ যদি চায়, ‘ভিক্ষা লহ’ ব’লে কেহ আসে দ্বার-পাশে।

প্রাণ আরো কেঁদে ওঠে তাতে,

গুমরিয়া ওঠে কাঙালের লজ্জাহীন গুর” বেদনাতে!

প্রলয়-পয়োধি-নীরে গর্জে-ওঠা হুহুঙ্কার-সম

বেদনা ও অভিমানে ফুলে’ ফুলে’ দুলে’ ওঠে ধূ-ধূ

ক্ষোভ-ক্ষিপ্ত প্রাণ-শিখা মম!

পথ-বালা আসে ভিক্ষা-হাতে,

লাথি মেরে চুর্ণ করি গর্ব তার ভিক্ষা-পাত্র সাথে।

কেঁদে তারা ফিরে যায়, ভয়ে কেহ নাহি আসে কাছে;

‘অনাথপিন্ডদ’-সম

মহাভিক্ষু প্রাণ মম

প্রেম-বুদ্ধ লাগি’ হায় দ্বারে দ্বারে মহাভিক্ষা যাচে,

“ভিক্ষা দাও, পুরবাসি!

বুদ্ধ লাগি’ ভিক্ষা মাগি, দ্বার হ’তে প্রভু ফিরে যায় উপবাসী!’’

কত এল কত গেল ফিরে,-

কেহ ভয়ে কেহ-বা বিস্ময়ে!

ভাঙা-বুকে কেহ,

কেহ অশ্র”-নীরে-

কত এল কত গেল ফিরে!

আমি যাচি পূর্ণ সমর্পণ,

বুঝিতে পারে না তাহা গৃহ-সুখী পুরনারীগণ।

তারা আসে হেসে;

শেষে হাসি-শেষে

কেঁদে তারা ফিরে যায়

আপনার গৃহ স্নেহ”ছায়ে।

বলে তারা, “হে পথিক! বল বল তব প্রাণ কোন্‌ ধন মাগে?

সুরে তব এত কান্না, বুকে তব কা’র লাগি এত ক্ষুধা জাগে?

কি যে চাই বুঝে না ক’ কেহ,

কেহ আনে প্রাণ মম কেহ- বা যৌবন ধন,

কেহ রূপ দেহ।

গর্বিতা ধনিকা আসে মদমত্তা আপনার ধনে

আমারে বাঁধিতে চাহে রূপ-ফাঁদে যৌবনের বনে।….

সর্ব ব্যর্থ, ফিরে চলে নিরাশায় প্রাণ

পথে পথে গেয়ে গেয়ে গান-

“কোথা মোর ভিখারিনী পূজারিণী কই?

যে বলিবে-‘ভালোবেসে সন্ন্যাসিনী আমি

ওগো মোর স্বামি!

রিক্তা আমি, আমি তব গরবিনী,বিজয়িনী নই!”

মর” মাঝে ছুটে ফিরি বৃথা,

হু হু ক’রে জ্ব’লে ওঠে তৃষা-

তারি মাঝে তৃষ্ণা-দগ্ধ প্রাণ

ক্ষণেকের তরে কবে হারাইল দিশা।

দূরে কার দেখা গেল হাতছানি যেন-

ডেকে ডেকে সে-ও কাঁদে-

‘আমি নাথ তব ভিখারিনী,

আমি তোমা’ চিনি,

তুমি মোরে চেন।’

বুঝিনু না, ডাকিনীর ডাক এ যে,

এ যে মিথ্যা মায়া,

জল নহে, এ যে খল, এ যে ছল মরীচিকা ছাষা!

‘ভিক্ষা দাও’ ব’লে আমি এনু তার দ্বারে,

কোথা ভিখারিনী? ওগো এ যে মিথ্যা মায়াবিনী,

ঘরে ডেকে মারে।

এ যে ক্রূর নিষাদের ফাঁদ,

এ যে ছলে জিনে নিতে চাহে ভিখারীর ঝুলির প্রসাদ।

হ’ল না সে জয়ী,

আপনার জালে প’ড়ে আপনি মরিল মিথ্যাময়ী।

কাঁটা-বেঁধা রক্ত মাথা প্রাণ নিয়ে এনু তব পুরে,

জানি নাই ব্যথাহত আমার ব্যথায়

তখনো তোমার প্রাণ পুড়ে।

তবু কেন কতবার মনে যেন হ’ত,

তব স্নিগ্ধ মদিন পরশ মুছে নিতে পারে মোর

সব জ্বালা সব দগ্ধ ক্ষত।

মনে হ’ত প্রাণে তব প্রাণে যেন কাঁদে অহরহ-

‘হে পথিক! ঐ কাঁটা মোরে দাও, কোথা তব ব্যথা বাজে

কহ মোরে কহ!

নীরব গোপন তুমি মৌন তাপসিনী,

তাই তব চির-মৌন ভাষা

শুনিয়াও শুনি নাই, বুঝিয়াও বুঝি নাই ঐ ক্ষুদ্র চাপা-বুকে

কাঁদে কত ভালোবাসা আশা!

এরি মাঝে কোথা হ’তে ভেসে এল মুক্তধারা মা আমার

সে ঝড়ের রাতে,

কোলে তুলে নিল মোরে, শত শত চুমা দিল সিক্ত আঁখি-পাতে।

কোথা গেল পথ-

কোথা গেল রথ-

ডুবে গেল সব শোক-জ্বালা,

জননীর ভালোবাসা এ ভাঙা দেউলে যেন দুলাইল দেয়ালীর আলা!

গত কথা গত জন্ম হেন

হারা-মায়ে পেয়ে আমি ভুলে গেনু যেন।

গৃহহারা গৃহ পেনু, অতি শান- সুখে

কত জন্ম পরে আমি প্রাণ ভ’রে ঘুমাইনু মুখ থুয়ে জননীর বুকে।

শেষ হ’ল পথ-গান গাওয়া,

ডেকে ডেকে ফিরে গেল হা-হা স্বরে পথসাথী তুফানের হাওয়া।

আবার আবার বুঝি ভুলিলাম পথ-

বুঝি কোন্‌ বিজয়িনী-দ্বার প্রানে- আসি’ বাধা পেল পার্থ-পথ-রথ।

ভুলে গেনু কারে মোর পথে পথ খোঁজা,-

ভুলে গেনু প্রাণ মোর নিত্যকাল ধ’রে অভিসারী

মাগে কোন্‌ পূজা,

ভুলে গেনু যত ব্যথা শোক,-

নব সুখ-অশ্র”ধারে গ’লে গেল হিয়া, ভিজে গেল অশ্র”হীন চোখ।

যেন কোন্‌ রূপ-কমলেতে মোর ডুবে গেল আঁখি,

সুরভিতে মেতে উঠে বুক,

উলসিয়া বিলসিয়া উথলিল প্রাণে

এ কী ব্যগ্র উগ্র ব্যথা-সুখ।

বাঁচিয়া নূতন ক’রে মরিল আবার

সীধু-লোভী বাণ-বেঁধা পাখী।….

…. ভেসে গেল রক্তে মোর মন্দিরের বেদী-

জাগিল না পাষাণ-প্রতিমা,

অপমানে দাবানল-সম তেজে

র”খিয়া উঠিল এইবার যত মোর ব্যথা-অর”নিমা।

হুঙ্কারিয়া ছুটিলাম বিদ্রোহের রক্ত-অশ্বে চড়ি’

বেদনার আদি-হেতু স্রষ্টা পানে মেঘ অভ্রভেদী,

ধূমধ্বজ প্রলয়ের ধূমকেতু-ধুমে

হিংসা হোমশিখা জ্বালি’ সৃজিলাম বিভীষিকা স্নেহ-মরা শুষ্ক মর”ভূমে।

…. এ কি মায়া! তার মাঝে মাঝে

মনে হ’ত কতদূরে হ’তে, প্রিয় মোর নাম ধ’রে যেন তব বীণা বাজে!

সে সুদূর গোপন পথের পানে চেয়ে

হিংসা-রক্ত-আঁখি মোর অশ্র”রাঙা বেদনার রসে যেত ছেয়ে।

সেই সুর সেই ডাক স্মরি’ স্মরি’

ভুলিলাম অতীতের জ্বালা,

বুঝিলাম তুমি সত্য-তুমি আছে,

অনাদৃতা তুমি মোর, তুমি মোরে মনে প্রাণে যাচ’,

একা তুমি বনবালা

মোর তরে গাঁথিতেছ মালা

আপনার মনে

লাজে সঙ্গোপনে।

জন্ম জন্ম ধ’রে চাওয়া তুমি মোর সেই ভিখারিনী।

অন-রের অগ্নি-সিন্ধু ফুল হ’য়ে হেসে উঠে কহে- ‘চিনি, চিনি।

বেঁচে ওঠ্‌ মরা প্রাণ! ডাকে তোরে দূর হ’তে সেই-

যার তরে এত বড় বিশ্বে তোর সুখ-শানি- নেই!’

তারি মাঝে

কাহার ক্রন্দন-ধ্বনি বাজে?

কে যেন রে পিছু ডেকে চীৎকারিয়া কয়-

‘বন্ধু এ যে অবেলায়! হতভাগ্য, এ যে অসময়!

শুনিনু না মানা, মানিনু না বাধা,

প্রাণে শুধু ভেসে আসে জন্মন-র হ’তে যেন বিরহিণী ললিতার কাঁদা!

ছুটে এনু তব পাশে

উর্ধ্বশ্বাসে,

মৃত্যু-পথ অগ্নি-রথ কোথা প’ড়ে কাঁদে, রক্ত-কেতু গেল উড়ে পুড়ে,

তোমার গোপান পূজা বিশ্বের আরাম নিয়া এলো বুক জুড়ে।



তারপর যা বলিব হারায়েছি আজ তার ভাষা;

আজ মোর প্রাণ নাই, অশ্র” নাই, নাই শক্তি আশা।

যা বলিব আজ ইহা গান নহে, ইহা শুধু রক্ত-ঝরা প্রাণ-রাঙা

অশ্র”-ভাঙা ভাষা।

ভাবিতেছ, লজ্জাহীন ভিখারীর প্রাণ-

সে-ও চাহে দেওয়ার সম্মান!

সত্য প্রিয়া, সত্য ইহা, আমিও তা স্মরি’

আজ শুধু হেসে হেসে মরি!

তবু শুধু এইটুকু জেনে রাখো প্রিয়তমা, দ্বার হ’তে দ্বারান-রে

ব্যর্থ হ’য়ে ফিরে

এসেছিনু তব পাশে, জীবনের শেষ চাওয়া চেয়েছিনু তোমা’,

প্রাণের সকল আশা সব প্রেম ভালোবাসা দিয়া

তোমারে পূজিয়াছিনু, ওগো মোর বে-দরদী পূজারিণী প্রিয়া!

ভেবেছিনু, বিশ্ব যারে পারে নাই তুমি নেবে তার ভার হেসে,

বিশ্ব-বিদ্রোহীরে তুমি করিবে শাসন

অবহেলে শুধু ভালোবাসে।

ভেবেছিনু, দুর্বিনীত দুর্জয়ীরে জয়ের গরবে

তব প্রাণে উদ্ভাসিবে অপরূপ জ্যোতি, তারপর একদিন

তুমি মোর এ বাহুতে মহাশক্তি সঞ্চারিয়া

বিদ্রোহীর জয়লক্ষ্মী হবে।

ছিল আশা, ছিল শক্তি, বিশ্বটারে টেনে

ছিঁড়ে তব রাঙা পদতলে ছিন্ন রাঙা পদ্মসম পূজা দেব এনে!

কিন’ হায়! কোথা সেই তুমি? কোথা সেই প্রাণ?

কোথা সেই নাড়ী-ছেঁড়া প্রাণে প্রাণে টান?

এ-তুমি আজ সে-তুমি তো নহ;

আজ হেরি-তুমিও ছলনাময়ী,

তুমিও হইতে চাও মিথ্যা দিয়া জয়ী!

কিছু মোরে দিতে চাও, অন্য তরে রাখ কিছু বাকী,-

দুর্ভাগিনী! দেখে হেসে মরি! কারে তুমি দিতে চাও ফাঁকি?

মোর বুকে জাগিছেন অহরহ সত্য ভগবান,

তাঁর দৃষ্টি বড় তীক্ষ্ন, এ দৃষ্টি যাহারে দেখে,

তন্ন তন্ন ক’রে খুঁজে দেখে তার প্রাণ!

লোভে আজ তব পূজা কলুষিত, প্রিয়া,

আজ তারে ভুলাইতে চাহ,

যারে তুমি পূজেছিলে পূর্ণ মন-প্রাণ সমর্পিয়া।

তাই আজি ভাবি, কার দোষে-

অকলঙ্ক তব হৃদি-পুরে

জ্বলিল এ মরণের আলো কবে প’শে?

তবু ভাবি, এ কি সত্য? তুমিও ছলনাময়ী?

যদি তাই হয়, তবে মায়াবিনী অয়ি!

ওরে দুষ্ট, তাই সত্য হোক।

জ্বালো তবে ভালো ক’রে জ্বালো মিথ্যালোক।

আমি তুমি সুর্য চন্দ্র গ্রহ তারা

সব মিথ্যা হোক;

জ্বালো ওরে মিথ্যাময়ী, জ্বালো তবে ভালো ক’রে

জ্বালো মিথ্যালোক।

তব মুখপানে চেয়ে আজ

বাজ-সম বাজে মর্মে লাজ;

তব অনাদর অবহেলা স্মরি’ স্মরি’

তারি সাথে স্মরি’ মোর নির্লজ্জতা

আমি আজ প্রাণে প্রাণে মরি।

মনে হয়-ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি, ‘মা বসুধা দ্বিধা হও!

ঘৃণাহত মাটিমাখা ছেলেরে তোমার

এ নির্লজ্জ মুখ-দেখা আলো হ’তে অন্ধকারে টেনে লও!

তবু বারে বারে আসি আশা-পথ বাহি’,

কিন’ হায়, যখনই ও-মুখ পানে চাহি-

মনে হয়,-হায়,হায়, কোথা সেই পূজারিণী,

কোথা সেই রিক্ত সন্ন্যাসিনী?

এ যে সেই চির-পরিচিত অবহেলা,

এ যে সেই চির-ভাবহীন মুখ!

পূর্ণা নয়, এ যে সেই প্রাণ নিয়ে ফাঁকি-

অপমানে ফেটে যায় বুক!

প্রাণ নিয়া এ কি নিদার”ণ খেলা খেলে এরা হায়!

রক্ত-ঝরা রাঙা বুক দ’লে অলক্তক পরে এরা পায়!

এর দেবী, এরা লোভী, এরা চাহে সর্বজন-প্রীতি!

ইহাদের তরে নহে প্রেমিকের পূর্ণ পূজা, পূজারীর পূর্ণ সমর্পণ,

পূজা হেরি’ ইহাদের ভীর” বুকে তাই জাগে এত সত্য-ভীতি।

নারী নাহি হ’তে চায় শুধু একা কারো,

এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো!

ইহাদের অতিলোভী মন

একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়,

যাচে বহু জন।..

যে-পূজা পূজিনি আমি স্রষ্টা ভগবানে,

যারে দিনু সেই পূজা সে-ই আজি প্রতারণা হানে।

বুঝিয়াছি, শেষবার ঘিরে আসে সাথী মোর মৃত্যু-ঘন আঁখি,

রিক্ত প্রাণ তিক্ত সুখে হুঙ্কারিয়া উঠে তাই,

কার তরে ওরে মন, আর কেন পথে পথে কাঁদি?

জ্বলে’ ওঠ্‌ এইবার মহাকাল ভৈরবের নেত্রজ্বালা সম ধ্বক্‌-ধ্বক্‌,

হাহাকার-করতালি বাজা! জ্বালা তোর বিদ্রোহের রক্তশিখা অনন- পাবক।

আন্‌ তোর বহ্নি-রথ, বাজা তোর সর্বনাশী তূরী!

হান্‌ তোর পরশু-ত্রিশুল! ধ্বংস কর্‌ এই মিথ্যাপুরী।

রক্ত-সুধা-বিষ আন্‌ মরণের ধর টিপে টুটি!

এ মিথ্যা জগৎ তোর অভিশপ্ত জগদ্দল চাপে হোক্‌ কুটি-কুটি!

কন্ঠে আজ এত বিষ, এত জ্বালা,

তবু, বালা,

থেকে থেকে মনে পড়ে-

যতদিন বাসিনি তোমারে ভালো,

যতদিন দেখিনি তোমার বুক-ঢাকা রাগ-রাঙা আলো,

তুমি ততদিনই

যেচেছিলে প্রেম মোর, ততদিনই ছিলে ভিখারিনী।

ততদিনই এতটুকু অনাদরে বিদ্রোহের তিক্ত অভিমানে

তব চোখে উছলাতো জল, ব্যথা দিত তব কাঁচা প্রাণে;

একটু আদর-কণা একটুকু সোহাগের লাগি’

কত নিশি-দিন তুমি মনে কর, মোর পাশে রহিয়াছ জাগি’,

আমি চেয়ে দেখি নাই; তারই প্রতিশোধ

নিলে বুঝি এতদিনে! মিথ্যা দিয়ে মোরে জিনে

অপমান ফাঁকি দিয়ে করিতেছ মোর শ্বাস-রোধ!

আজ আমি মরণের বুক থেকে কাঁদি-

অকর”ণা! প্রাণ নিয়ে এ কি মিথ্যা অকর”ণ খেলা!

এত ভালোবেসে শেষে এত অবহেলা

কেমনে হানিতে পার, নারী!

এ আঘাত পুর”ষের,

হানিতে এ নির্মম আঘাত, জানিতাম মোরা শুধু পুর”ষেরা পারি।

ভাবিতাম, দাগহীন অকলঙ্ক কুমারীর দান,

একটি নিমেষ মাঝে চিরতরে আপনারে রিক্ত করি’ দিয়া

মন-প্রাণ লভে অবসান।

ভুল, তাহা ভুল

বায়ু শুধু ফোটায় কলিকা, অলি এসে হ’রে নেয় ফুল!

বায়ু বলী, তার তরে প্রেম নহে প্রিয়া!

অলি শুধু জানে ভালো কেমনে দলিতে হয় ফুল-কলি-হিয়া!

পথিক-দখিনা-বায়ু আমি চলিলাম বসনে-র শেষে

মৃত্যুহীন চিররাত্রি নাহি-জানা দেশে!

বিদায়ের বেলা মোর ক্ষণে ক্ষণে ওঠে বুকে আনন্দাশ্র” ভরি’

কত সুখী আমি আজ সেই কথা স্মরি’!

আমি না বাসিতে ভালো তুমি আগে বেসেছিলে ভালো,

কুমারী-বুকের তব সব স্নিগ্ধ রাগ-রাঙা আলো

প্রথম পড়িয়াছিল মোর বুকে-মুখে-

ভুখারীর ভাঙা বুকে পুলকের রাঙা বান ডেকে যায় আজ সেই সুখে!

সেই প্রীতি, সেই রাঙা সুখ-স্মৃতি স্মরি’

মনে হয় এ জীবন এ জনম ধন্য হ’ল- আমি আজ তৃপ্ত হ’য়ে মরি!

না-চাহিতে বেসেছিলে ভালো মোরে তুমি-শুধু তুমি,

সেই সুখে মৃত্যু-কৃষ্ণ অধর ভরিয়া

আজ আমি শতবার ক’রে তব প্রিয় নাম চুমি’।

মোরে মনে প’ড়ে-

একদা নিশীথে যদি প্রিয়

ঘুশায়ে কাহারও বুকে অকারণে বুক ব্যথা করে,

মনে ক’রো, মরিয়াছে, গিয়াছে আপদ!

আর কভু আসিবে না

উগ্র সুখে কেহ তব চুমিতে ও-পদ-কোকনদ!

মরিয়াছে-অশান- অতৃপ্ত চির-স্বার্থপর লোভী,-

অমর হইয়া আছে-র’বে চিরদিন

তব প্রেমে মৃত্যুঞ্জয়ী

ব্যথা-বিষে নীলকণ্ঠ কবি!

No comments:

Post a Comment