Saturday, December 24, 2016

প্রাচ্য-পৌরাণিক নারী তারা


তারা হলেন নক্ষত্ররাজ্যের দেবী। তারা বৃহস্পতির স্ত্রী। বৃহস্পতি দেবতাদের পুরোহিত। তারা অতি সুন্দরী যুবতী। একদিন সোম বা চন্দ্র তারাকে দেখে তাঁর রূপে এত অধীর ও মুগ্ধ হয়ে গেলেন যে, তারাকে বৃহস্পতির কাছ থেকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে নিজের প্রাসাদে আটকে রাখেন। বৃহস্পতি বা ব্রহ্মার শত অনুরোধেও সোম তারাকে ফিরিয়ে দেন না। সমস্ত দেবকুল তখন সোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সোমের হয়ে লড়াই করে অসুরগণ, যার অধিপতি শুত্রু। বিশাল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মারামারি, কাটাকাটি করে সর্বাংশে ধ্বংস হয়ে যাবার ভয়ে ব্রহ্মা আবার ফিরে আসেন সোমের কাছে; সোমকে তিনি বোঝান। সোম এবার রাজি হন এবং তারাকে মুক্ত করে দেন। তারা ফিরে আসেন বৃহস্পতির কাছে। কিন্তু অচিরেই টের পাওয়া যায়, তারা অন্তঃসত্ত্বা। বৃহস্পতি জানতে চান, এই সন্তানের পিতা কে - তিনি না সোম? কিন্তু তারা কিছুতেই তার জবাব দেন না। বৃহস্পতি তখন সন্তান জন্মের আগে তারাকে গ্রহণ করতে অসম্মতি জানান। বলেন, যতক্ষণ পুত্র জন্মলাভ না করছে তারাকে তিনি গ্রহণ করবেন না। এ-কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে তারার গর্ভের পুত্র জন্মগ্রহণ করে ফেলে। উজ্জ্বল সুন্দর দিব্যকান্তির পুত্রকে দেখে সোম ও বৃহস্পতি উভয়েই তাকে নিজের সন্তান বলে দাবি করেন। তাদের মধ্যে এত রেষারেষি, কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব দেখে শিশুটি রেগে গিয়ে উভয়েকেই অভিশাপ দিতে উদ্যত হলে ব্রহ্মা আবার আসেন তাদের উদ্ধারে। তিনি তারাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বিশেষভাবে জানতে চান আসলেই এই শিশুর পিতা কে - বৃহস্পতি না সোম। তখন তারা স্পষ্ট জানান, সোম। সোম সানন্দে পুত্রকে গ্রহণ করেন এবং তার নাম রাখেন বুধ।

পুরাণে তারার কাহিনি এভাবে বর্ণিত হলেও বীরাঙ্গনা কাব্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের চোখে সোম-তারার সম্পর্ক ভিন্নভাবে, নবরূপে ধরা দিয়েছে। মধুসূদন তাদের সম্পর্ককে অনেকটা কচ-দেবযানীর সম্পর্কের মতো করে এঁকেছেন। এখানে তারাকে তিনি দেবযানীর মতো গুরু-কন্যা না করে কল্পনা করেছেন গুরুপত্নী হিসেবে। গুরুপত্নী প্রায় মায়ের স্থলাভিষিক্ত। ফলে এই প্রেম বৈধ নয়। মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যে দেবতাদের পুরোহিত বৃহস্পতি সোমের গুরু। শিক্ষাশেষে সোম যখন গুরুগৃহ ত্যাগ করতে উদ্যত, তখন তাঁর সান্নিধ্যের জন্যে উদ্গ্রীব, তাঁর প্রেমে অধীর গুরুপত্নী তারা সোমকে তাঁর গভীর প্রণয়ের কথা প্রকাশ করে একখানা পত্র লেখেন। সোমের আসন্ন বিরহে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন তারা, যদিও তিনি সম্পূর্ণ অবগত যে, বৃহস্পতি সোমের গুরু। সেই হিসেবে গুরুপত্নীর সঙ্গে রোমান্টিক প্রেমের সম্পর্ক সম্পূর্ণ অনৈতিক। এর জন্যে তারার মনেও বহু দ্বিধা, সংকোচ ও অপরাধবোধ। কিন্তু সোমের প্রতি তাঁর বাঁধভাঙা ভালোবাসার কাছে ভেসে যায় সেই শাস্ত্রীয় নিয়মকানুন, সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সতীত্বরক্ষার অলিখিত নির্দেশ। আসন্ন বিদায়ী সোমকে লেখা তারার সেই চিঠিতে অনেক উদ্ধৃতি, অনেক অতীত দৃশ্যের অবতারণা, অনেক যৌথ অভিজ্ঞতার উল্লেখ রয়েছে। এসব থেকে পাঠককুল নিশ্চিন্ত হবেন যে, তারা এবং সোম দুজনেই দুজনকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন - অনেক দিন থেকেই। ফলে বীরাঙ্গনা কাব্যের ‘সোমের প্রতি তারা’ পত্র পাঠ করলে মনে হবে সোমের এই তারা-অপহরণ প্রকৃতপক্ষে কোনো অপহরণ ছিল না। অথবা এই সাজানো অপহরণ তারার সহযোগিতা বা ইন্ধনেই ঘটেছিল। কিন্তু পুরাণে তাদের অপহরণপূর্ব কোনো সম্পর্ক বা সোমের অন্তঃপুরে স্বেচ্ছায় তারার গমনের কোনো উল্লেখ নেই। এমনকি সোম যে বৃহস্পতির শিষ্য, সে-কথাও কোথাও লিপিবদ্ধ নেই।
(http://archive.sahos24.com/2014/08/16/12105/print )

No comments:

Post a Comment